-->
শিরোনাম

মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির ৯০ শতাংশই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়

এক মাসে ময়লার গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ গেল পাঁচজনের

রাজন ভট্টাচার্য
মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির ৯০ শতাংশই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়
ডিএনসিসির ময়লার গাড়ি। ফাইল ছবি

ফের ময়লার গাড়িতে প্রাণ গেল একজনের। রাজধানীর মহাখালীতে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতের নাম শিখা রানী। তিনি সিটি করপোরেশনেরই পরিচ্ছনতাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। মহাখালীর ফ্লাইওভারের মুখে শনিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে ঝাড়ু দেওয়ার সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে পুলিশ জানায়, শিখা রানী মহাখালী ফ্লাইওভারের ওপরে রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। এ সময় একটা ময়লার গাড়ি বেপরোয়া গতিতে এসে তাকে চাপা দেয়। তার মাথা ফেটে যায়। আহত অবস্থায় উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

গত ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ময়লার গাড়ির ধাক্কায় স্বপন কুমার সরকার নামের এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়। এর আগে ২৪ নভেম্বর রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় ডিএসসিসির এক ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নাঈম হাসান নামের নটর ডেমের এক শিক্ষার্থী নিহত হন।

পরের দিনই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) এক ময়লার গাড়ির ধাক্কায় বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সের উল্টো পাশে প্রাণ যায় আহসান কবির খানের। তিনি একটি জাতীয় দৈনিকের সাবেক কর্মী ছিলেন। ২ ডিসেম্বর উত্তর সিটি করপোরেশনেরই এক ময়লার গাড়ি যাত্রীবাহী একটি বাসকে ধাক্কা দিলে আরজু বেগম নামের ৬৫ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা আহত হন।

এক মাসে শুধু সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন অন্তত পাঁচজন। সব মিলিয়ে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি এখন সড়কে আতঙ্কের নাম। যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত! যেকোনো সময় রাজধানীর পথে যে কারো প্রাণ যেতে পারে ময়লা যানের চাপায়।

এরকম একেকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় পথে বসতে পারে নিহতের পরিবার। অথচ এ নিয়ে কারো তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। বছরের পর বছর অনুমোদনহীন চালকদের হাতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িতে একের পর এক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর এসব তথ্য বেরিয়ে আসছে।

এসব ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছেন মেয়ররাও। তারাও বিষয়টি এতো পরিষ্কারভাবে জানতেন না। তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বৈধ চালক ছাড়া গাড়ি চালানো নিষেধ করা হলেও ময়লা অপসারণ নিয়ে নতুন করে জটিলতার মুখে পড়তে হয় দুই সিটি কর্তৃপক্ষকে। এখন তড়িঘড়ি করে লাইসেন্সধারী বৈধ চালক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

পরিচ্ছন্নতাকর্মী দিয়ে গাড়ি চালানোর বিষয়ে ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, শিগগির চালক নিয়োগ করা হবে। চালকের লাইসেন্স ছাড়া কোনো গাড়ি কেউ রাস্তায় নামাতে পারবে না। এ ছাড়াও বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বর্জ্যরে কোনো গাড়ি দিনের বেলা চালানো যাবে না।

ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের জানান, নিজের নামে বরাদ্দ হওয়া গাড়ি নিজে না চালিয়ে অন্য গাড়িচালক দিয়ে চালানোর কারণে গত ১৩ ডিসেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভারী গাড়ির সাতজন এবং হালকা গাড়ির দুজন চালককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।

২৫ নভেম্বর রাজধানীর পান্থপথে ডিএনসিসির ময়লার গাড়িচাপায় আহসান কবীর খান নামের একজন সংবাদকর্মী মারা যান।

ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবুল বাশার মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান, ওই ময়লার গাড়িচালকের নাম মো. হানিফ ওরফে ফটিক। তিনি ডিএনসিসির নিয়োগপ্রাপ্ত চালক ছিলেন না। হানিফ মূলত সংস্থাটির মালি। এ ঘটনার পর সে দুদিন পলাতক ছিল। চাঁদপুর থেকে পরে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। 

গত ২৪ নভেম্বর নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসানকে যে ময়লা ফেলার ট্রাকটি হত্যা করেছে, সেই ট্রাকটিও এমন ব্যবস্থাতেই চালানো হচ্ছিল। গাড়িটি পরিচালনা করার কথা স্টাফ ড্রাইভার মো. ইরান মিয়ার হলেও তিনি ডিএসসিসির ক্লিনার মো. হারুন মিয়ার কাছে গাড়িটি ভাড়া দেন।

পরবর্তীতে হারুন মিয়া আবার গাড়িটি ভাড়া দেন ডিএসসিসির সাবেক চুক্তিভিত্তিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাসেল খানকে। নাঈম নিহত হওয়ার সময় এই রাসেল খানই গাড়িটি চালাচ্ছিলেন।

ডিএনসিসি পরিবহণ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আবর্জনা ট্রাক চালানোর জন্য আমাদের চালক কম আছে। অপারেশন চালানোর জন্য আমরা বেশির ভাগ মাস্টার রোল ড্রাইভারের উপর নির্ভর করি।’

তিনি বলেন, মাস্টার রোলের সমস্ত আবেদনকারীর ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং পর্যাপ্ত দক্ষতা রয়েছে কি না তা যাচাই করা হয়। বর্তমানে মোট ১৮৪টি আবর্জনা বহনকারী গাড়ির চালকের পদ খালি রয়েছে। যেগুলোয় শিগগিরই নিয়োগ শুরু হবে।

ডিএসসিসির মহাব্যবস্থাপক (পরিবহণ) বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে ব্যবহারের জন্য ৩১৭টি ভারী ট্রাক আছে। অথচ চালক আছেন মাত্র ৮৬ জন। তাই বাধ্য হয়ে বাকি গাড়িগুলো পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা চালায়।

এদের অধিকাংশেরই ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। ফলে অদক্ষ চালকের কারণে গাড়িগুলোতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। এমন পরিস্থিতিতে ৮ ডিসেম্বর ৩২ জন চালক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয় ডিএসসিসি।

বিআরটি এর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব ভারী যানের অধিকাংশেরই মেয়াদ ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। তার ওপর যারা এগুলো চালাচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই অদক্ষ ও অপেশাদার।

দক্ষিণ সিটির পরিবহণ বিভাগ সূত্র বলছে, তাদের ৩১৭টি ভারী যান আছে। কিন্তু চালক আছেন মাত্র ৮৬ জন। অর্থাৎ বেশির ভাগ ভারী যানই চালাচ্ছেন অদক্ষ ও অপেশাদার চালকরা। ঘাটতি মেটাতে গত বছর স্থানীয় সরকারের কাছে ১০৭ জন চালক নিয়োগের চিঠি দেয় ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। জবাবে ৫০ জন চালক নিয়োগের অনুমিত পায় সংস্থাটি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়- বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, ‘এখানে হয়তো একটি ব্যবস্থা থাকতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, মাস্টার রোল চালকরা প্রায়ই নিজেরা যানবাহন চালায় না। তারা ভারী ট্রাকগুলো বহিরাগতদের কাছে হস্তান্তর করে দেয়, কারণ তাদের মনিটরিং করা হয় না, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দেয়।’

যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘সড়কে কারো প্রাণ যাক আমরা চাই না। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের গাড়িতে কারো প্রাণ যাওয়া আরো বেশি দুঃখজনক।

‘একের পর এক ময়লার গাড়িচাপায় মানুষের মৃত্যুরে দায় দুই সিটির মেয়ররা এড়াতে পারেন না। তাদের সকল নাগরিককে সেবা দেওয়া দায়িত্ব, প্রাণ কেড়ে নেওয়ার নয়।’

মন্তব্য

Beta version