-->
শিরোনাম

রাজধানীর বায়ুদূষণে ৫৮ শতাংশ দায়ী চারপাশের ইটভাটা

শাহীন রহমান
রাজধানীর বায়ুদূষণে ৫৮ শতাংশ দায়ী চারপাশের ইটভাটা
রাজধানীর উপকণ্ঠে মুন্সীগঞ্জের একটি ইটভাটা। ফাইল ছবি

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জরিপে বায়ুদূষণের তালিকায় বার বার উঠে আসছে রাজধানী ঢাকার নাম। দশক ধরে এসব গবেষণায় বিশ্বের ১৭৮টি শহরের মধ্যে দিল্লির পরই দূষণের শীর্ষে থাকছে ঢাকা।

প্রশ্ন উঠছে- ঢাকার বায়ুদূষণ কেন এত তীব্র আকার ধারণ করছে? বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণায় প্রথমত যে কারণটি বার বারই সামনে আসছে, তা হলো- রাজধানীর চারপাশে গড়ে ওঠা ইটভাটা এর জন্য প্রধানত দায়ী।

এক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ বলছে, ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ৫৮ শতাংশ দায়ী ইটভাটা।

প্রতিষ্ঠানটির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ইটভাটা থেকে নিঃসরিত দূষণের অন্যতম উপাদান হচ্ছে কার্বন মনোক্সাইড, অক্সাইড অব সালফার, বস্তুকণা ও উদ্বায়ী জৈব যৌগ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদনেরও এ বড় উৎস ইটভাটা। এছাড়া রাজধানীর বাকি বায়ুদূষণ ঘটছে যানবাহনের জীবাশ্ম জ্বালানি দহন ও শিল্প-কারখানার দূষিত ধোঁয়ার মাধ্যমে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশে স্থাপিত বায়ুদূষণের মান পরীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে সার্বক্ষণিক বায়ুর মান যাচাইয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এতে দেখা গেছে, রাজধানীর ঢাকার বায়ুদূষণ শুষ্ক মৌসুমে; বিশেষ করে নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এ সময় বায়ুদূষণের অন্যতম উপাদান যেমন পার্টিক্যাল ম্যাটার বা বস্তুকণা-১০ ও বস্তুকণা-২.২৫ বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।

দূষণ বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে রাজধানী ও এর আশপাশে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলোকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সময়ে বায়ুদূষণের মূল কারণ হলো ইটভাটা চালু হওয়া, বৃষ্টিপাত কম হওয়া। বাতাসের গতিবেগ কম থাকার কারণে রাস্তাঘাটে বস্তুকণার উপস্থিতি প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যাচ্ছে।

জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহর ও নগরাঞ্চলের বায়ুদূষণের মান পরিবীক্ষণের জন্য সার্বক্ষণিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এসব কেন্দ্র থেকে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর বায়ুদূষণকারী পদার্থের ক্ষতিকর দিক ও মাত্রা নিরূপণ করা হচ্ছে।

বাতাসে ভেসে বেড়ানো দূষণ পদার্থে মধ্যে রয়েছে পার্টিক্যাল ম্যাটার বা বস্তুকণা-২.৫, বস্তুকণা-১০, কার্বন মনোক্সাইড, ওজোন, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেনের অক্সাইড।

এছাড়া এসব কেন্দ্রে আবহাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত উপাত্তগুলো; যেমন বায়ুর গতি, বায়ুর দিক, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, উলম্ব বায়ুর গতি বায়ুর মানযন্ত্রের পরিবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে সার্বক্ষণিক পরীক্ষা করা হচ্ছে।

এতে দেখা গেছে, দেশে প্রধানত শুষ্ক মৌসুমে; বিশেষ করে শীত মৌসুমে বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এ সময়ে বায়ুদূষণের প্রধান উপাদান মূলত পার্টিক্যাল ম্যাটার বা বস্তুকণা। বিশেষ করে এ কণার পরিমাণ যখন ২.৫-এর মাত্রায় চলে আসে, তখনই তা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে বায়ুদূষণ।

বায়ুর মান যন্ত্রের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য স্থাপন করা হয়েছে একটি কেন্দ্রীয় উপাত্ত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। এখানে একটি কম্পিউটার সফটওয়্যারের মাধ্যমে সব মনিটরিং কেন্দ্রের ডাটাবেজে প্রবেশ করে কেন্দ্রীয় সার্ভারের মাধমে সব মনিটরিং কেন্দ্রের উপাত্ত একসঙ্গে অবলোকন করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সার্ভার কক্ষটি সার্বক্ষণিক ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন কেন্দ্রে স্থাপিত বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, রাজধানীর ঢাকার বায়ুদূষণের বড় কারণ হলো ইটভাটা। ইটভাটার পোড়া জ্বালানির দূষণ সরাসরি রাজধানীর বাতাসে সহজেই মিশে যাচ্ছে। এ দূষণের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা।

তিনি বলেন, বড়দের চেয়ে শিশুরা ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে থাকে। দূষণের জীবাণু শিশুদের দেহে বেশি মাত্রায় প্রবেশ করছে। শুধু শিশু নয়, রাজধানীতে বসবাসকারী সবাই কমবেশি বায়ুদূষণের শিকার। দূষণের কারণেই স্বাস্থ্যগত সমস্যা দিন দিন বাড়ছে।

শুধু পরিবেশ অধিদপ্তর নয়, বায়ুদূষণ নিয়ে এখন পর্যন্ত যতগুলো গবেষণা হয়েছে, সবগুলোয় প্রধান কারণ হিসেবে ইটভাটাকে উল্লেখ করা হয়েছে।

সম্প্রতি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র থেকে এ বিষয়ে একটি জরিপ চালানো হয়েছে।

এতে উল্লেখ করা হয়, রাজধানীর বায়ুদূষণে ২৯ শতাংশ দায়ী ইটভাট ও শিল্পকারখানার কালো ধোঁয়া। এছাড়া গবেষণা অন্য যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজ দায়ী ৩০ শতাংশ। যানবাহনের কালো ধোঁয়া দায়ী ১৫, আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ ১০, গৃহস্থালী ও রান্নার চুলা থেকে নির্গত দূষক ৯ এবং বর্জ্য পোড়ানোর ৭ শতাংশ।

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, সাধারণত শীত মৌসুমে গড় বায়ুমান সূচক বাড়তে দেখা যায়। ঋতুর দিক দিয়ে শীতকাল অপেক্ষাকৃত শুষ্ক। এ সময়েই ধুলাবালির পরিমাণও অধিক হারে বাড়ে।

ইটভাটাগুলো শুষ্ক মৌসুমে চলমান থাকে, বায়ুর দূষকগুলো প্রধানত আবহাওয়ার উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়। শীতকালে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কম থাকে। যার ফলে এ সময়ে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ায়।

অন্যদিকে বর্ষাকালে ইটভাটাগুলো বন্ধ থাকে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা দূষণের পরিমাণ কমিয়ে আনে। এ কারণে জুন এবং জুলাই মাসে গড় বায়ুমান সূচক তুলনামূলক কম পাওয়া যায় সবগুলো।

অন্যদিকে সম্প্রতি চালানো টিআইবির গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, রাজধানীর সবচেয়ে বেশিষ মাত্রায় বায়ুদূষণের উৎসও হচ্ছে আশপাশে গড়ে ওঠা ইটভাটা। দূষণে ৩৮ শতাংশ দায়ী এ ইটভাটা। এরপরই রয়েছে রাজধানীতে চলাচলকারী যানবাহনগুলো। ১৯ শতাংশ দায়ী পরিবহণগুলো থেকে বের হওয়া ধোঁয়া।

এছাড়া বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে রাস্তার ধূলিকণা বাতাসে মিশে দূষণ ঘটাচ্ছে। ১৮ শতাংশ দায়ী হচ্ছে রাস্তার ধূলিকণা।

পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের সব ইটভাটা পরিবেশবান্ধব উন্নত প্রযুক্তিতে রূপান্তরের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তিতে রূপান্তরে সফলতা পাওয়া গেলেও ঢাকা ও চট্টগ্রামকে এখনো এ প্রযুক্তিতে আনা সম্ভব হয়নি। মহানগরের পাশে যত্রতত্র গড়ে ওঠা ইটভাটা ও যানবাহনের ধোঁয়াই বায়ুদূষণের জন্য অধিক দায়ী।

মন্তব্য

Beta version