-->
শিরোনাম

বর্জ্য-ভোগান্তিতে নগরবাসী

রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় রাতে নয়, দিনেই চলছে ময়লা-আবর্জনা অপসরাণের কাজ

নাজমুল হাসান রাজ
বর্জ্য-ভোগান্তিতে নগরবাসী
ডাস্টবিনে জমা বর্জ্যরে দুর্গন্ধে রীতিমতো নাকাল রাজধানীবাসী। ছবি- ভোরের আকাশ

যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী আসমা ইসলাম। সকালের প্রাইভেট শেষ করে বাসায় ফিরছিল। কাজলার পাড় ঢুকতেই তাকে অতিক্রম করল উন্মুক্ত একটি বর্জ্যবাহী ভারী ট্রাক। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, বমি করে দিল আসমা। গাড়ি ত্যাগ করতেই দৌড় দিয়ে কোনোভাবে রাস্তা পার হলো সে। নগরবাসীর এমন বিড়ম্বনা আর ভোগান্তি নিত্যদিনের সঙ্গী।

প্রায় ২ কোটি মানুষের এ শহরে প্রতিনিয়ত বাড়ছে সমস্যার পরিধি। অন্যান্য সমস্যার মধ্যে নিত্যদিনের বড় এক সমস্যার নাম বর্জ্য। বাসাবাড়ির ময়লাসহ প্রতিদিন উৎপন্ন হয় ব্যাপক পরিমাণ বর্জ্য। রাজপথ থেকে অলিগলি যেন যত্রতত্র ডাস্টবিন।

আর এসব ডাস্টবিনে জমা বর্জ্যরে দুর্গন্ধে রীতিমতো নাকাল রাজধানীবাসী। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনই হাইকোর্টের নির্দেশনা উপেক্ষা করে বেশিরভাগ এলাকায় রাতে নয়, দিনেই বর্জ্য অপসরাণের কাজ করছে। দেখেও যেন কিছুই করার নেই কারোর।

জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আর্বানাইজেশন প্রসপেক্টের রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ। বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষা মতে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন বর্জ্য জমা হচ্ছে প্রায় ৭ হাজার টন। এর মধ্যে গৃহস্থালী ও দোকান থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার টন ময়লা তৈরি হয়।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের ১৬ অক্টোবর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সব বর্জ্য রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টার মধ্যে অপসারণের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি ঢাকনা ছাড়া ট্রাক বা ভ্যান দিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহণ বন্ধেও ব্যবস্থা নিতেও বলা হয় ওই আদেশে।

প্রায় ৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের অধীনে ১০২টি ট্রান্সফার স্টেশন রয়েছে। ঢাকা শহরে ৪ হাজারের মতো পাড়াভিত্তিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী রয়েছেন, যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ময়লা সংগ্রহ করেন। তারা সবাই ছোট ছোট বেসরকারি সংস্থা বা আবাসিক সমিতি দ্বারা পরিচালিত।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৫০০ থেকে ৩০০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। মৌসুমি ফলের সময় এর পরিমাণ বাড়ে।

অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ২৪০০ থেকে ২৭০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এসব বর্জ্য সংগ্রহ করে আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে নেওয়া হয়। এখন প্রতিদিন ঢাকার দুই সিটিতে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়।

কিন্তু মেগাসিটি ঢাকায় এখনো আধুনিক, টেকসই ও উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তবে সংস্থা দুটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

মানিক নগরের বাসিন্দা ব্যাংকার নেয়ামত বলেন, সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ি রাখায় আমরা দুর্গন্ধে বাসার জানালা খোলা রাখতে পারি না। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এসটিএস (সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনের) সামনে ১০০টির বেশি আবর্জনা বোঝাই ভ্যান সারা দিন দাঁড়িয়ে থাকায় দুর্গন্ধ-দূষণে এলাকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগ এখন চরমে।

গৃহস্থালীর আবর্জনা সংগ্রহ করার পর ভ্যানগুলোকে এসটিএসের ভেতরে লম্বা দেয়াল এবং একটি শেডের ওপরে ময়লা ফেলার কথা। তারপর ময়লা ফেলা হবে ডাম্পিংয়ের জন্য ল্যান্ডফিলে।

গৃহস্থালীর সংগ্রহ থেকে শুরু করে ল্যান্ডফিল নিষ্পত্তি পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি রাতেই সম্পন্ন হওয়ার কথা; যাতে একটি স্মার্ট বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দুর্গন্ধ-দূষণ এবং আবর্জনার উপদ্রব ন্যূনতম স্তরে রাখতে পারে।

মানিকনগরের এসটিএসের সামনে ভ্যান পার্ক করা গৃহস্থালীর আবর্জনা এক সংগ্রহকারী বলেন, বর্জ্য পরিবহণ চালকের তীব্র ঘাটতির কারণে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। আমরা দিনের বেলা স্টেশনের সামনে আবর্জনা বোঝাই ভ্যান রাখি এবং রাতে বড় যানবাহনে আবর্জনা লোড করে ল্যান্ডফিলে ফেলা হয়।

এছাড়া রাজধানীর গুলশান, খিলক্ষেত, ফার্মগেট, মিরপুর, কলাবাগান, তেজগাঁও, মগবাজার, পল্টন, পান্থপথ ও পুরান ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকায় দেখা গেছে, দিন-দুপুরে ময়লবাহী ট্রাক বা ভ্যানে করে চলছে ময়লা পরিবহণের কাজ। কিন্তু নগরবাসীর দুর্ভোগের কারণে এসব ময়লা দিনের বেলা অপসারণ করা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেওয়ার পরও তারা অমান্য করেই চলছে।

এদিকে ডিএনসিসির খিলক্ষেত এলাকায় ভ্যানে ময়লা অপসারণের কাজ করছিলেন তিন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। এতে করে অফিসগামী নাগরিক, পথচারীরা দুর্গন্ধে নাকাল হয়ে রুমালে নাক চেপে রাস্তা পার হচ্ছিলেন।

তাদের মধ্যে একজন বেসরকারি চাকরিজীবী নূরুল ইসলাম। তিনি বলেন, যতদূর জানি, দিনের বেলা ময়লা অপসরাণ করা যাবে না বলে হাইকোর্টের নির্দেশ আছে। দিনের বেলায় মানুষ চলাচল করে, এর মধ্যে যদি এসব বর্জ্য অপসারণের কাজ করা হয়, তাহলে দুর্গন্ধের দুর্ভোগ বাড়ে নাগরিকদের। তাই সিটি করপোরেশনের উচিত নাগরিকদের কষ্ট দিয়ে দিনের বেলায় এসব কাজ না করা।

এ বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা সিতওয়াত নাঈম বলেন, ঢাকার একটা অদ্ভুত ব্যাপার রয়েছে। এখানে মেইন রোড, লেন-বাইলেন যেকোনো রাস্তা বলেন, সবখানে মুদি দোকান, হকার, চা বিক্রেতা, ফল বিক্রেতা বা কাঁচাবাজার রয়েছে। তারা সারা দিন ধরে রাস্তায় ময়লা ফেলতে থাকে। বাসা বাড়ি থেকেও ফেলা হচ্ছে।

সিটি করপোরেশন সকালে একবার ময়লা পরিষ্কার করে। নির্দিষ্ট স্থানে না ফেলে সারা দিন ধরে ছড়ানো ছিটানোভাবে ময়লা ফেললে শহরে তো আবর্জনা থাকবেই।

তিনি আরো বলেন, আমাদের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এসব বর্জ্য অপসারণের জন্য রাত থেকেই কাজে নেমে যান। রাজধানীতে বাসাবাড়ির এসব ময়লার পরিমাণ অনেক বেশি। তাই সব পরিষ্কার করতে কিছুটা সময় বেশি লেগে যায়। যদিও আমাদের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সকালের মধ্যেই প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ শেষ করে ফেলেন। বাকিটা হয়তো দিনের বেলায় কাজ শেষ করা হয়।

আমরা চেষ্টা করছি সময়মতো পরিচ্ছন্ন করতে। এ বিষয়ে আরো যা যা করা দরকার, আমরা সেটার পদক্ষেপ নেব। এ কর্মকর্তা দাবি করে বলেন, নগরবাসীর অসচেতনতার কারণেই যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। নগরবাসীর যেখানে-সেখানে আবর্জনা ফেলার পেছনে ব্যবস্থাপনার দায় সিটি করপোরেশনের ওপরেই বর্তায় বলে মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমোডর এস এম শরীফ-উল ইসলামের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, রাতের বেলায় ময়লা ফেলার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তবে সম্প্রতি ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মানসম্মত করতে কাউন্সিলরদের সঙ্গে ইতোমধ্যেই বৈঠক হয়েছে। শিগগিরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।

রাত থেকেই আমাদের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বর্জ্য অপসারণের কাজ শুরু করেন। কোনো কোনোদিন হয়তো দিনের বেলা বর্জ্য অপসারণ করা হয়, যা নগরবাসীর দুর্ভোগের কারণ। আমাদের যে জনবল আছে, তা দিয়ে আমরা চেষ্টা করছি সঠিক সময়ে, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বর্জ্য অপসারণ করতে।

নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, শহরে যখন যথোপযুক্ত বজ্য ব্যবস্থাপনা করবেন, তখনই আপনি প্রত্যাশা করতে পারেন-জনগণ যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলবে না। উপযুক্ত পরিবেশ, ব্যবস্থা তৈরি করা প্রয়োজন।

সিটি করপোরেশনের যে নেটওয়ার্ক ম্যানেজমেন্ট থাকার কথা, সেটিও এখন পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিতভাবে পাওয়া যায়নি। নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলতে এবং রাস্তা-ফুটপাত পরিচ্ছন্ন রাখতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সচেতনতা তৈরিতে সিটি করপোরেশনকে নিতে হবে বিভিন্ন পদক্ষেপ।

নগরবাসীর যেখানে-সেখানে আবর্জনা ফেলার পেছনে প্রধানভাবে ব্যবস্থাপনার দায় আছে বলেও মনে করেন তিনি। বর্জ্য অপসারণে নগর প্রশাসনের তৎপরতার অভাবে নানা ধরনের রোগ ছড়াচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।

বাপার যুগ্ম সম্পাদক শরীফ জামিলের সঙ্গে এ বিষয় আলাপকালে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার জন্য ঢাকা আবর্জনার শহরে পরিণত হচ্ছে। সারা ঢাকা শহরে এখন মশার উপদ্রব বাড়ছে। নগর প্রশাসন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে একটু নজর দিলে ডেঙ্গুসহ নানা রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

মন্তব্য

Beta version