-->

শীতলক্ষ্যায় চোখ রাঙাচ্ছে ‘সাকার ফিশ’

বিল্লাল হোসাইন, নারায়ণগঞ্জ
শীতলক্ষ্যায় চোখ রাঙাচ্ছে ‘সাকার ফিশ’
সাকার ফিশ হাতে এক শিশু। ছবি ভোরের আকাশ

একসময় শীতলক্ষ্যা নদীর মাছ বিক্রি করে সংসার চালাতেন নজরুল জেলে। তার মতো শীতলক্ষ্যায় জেলেপল্লির আরো অর্ধশত পরিবার চলত একইভাবে। তবে এ নদীর পানি এখন এতটাই দূষিত যে, সেখানে জলজপ্রাণীর অস্তিত্ব মারাত্মক সংকটে। শত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ নদী এখন মৃতপ্রায়।

তাই পেশা বদলে নজরুল এখন নৌকা চালান। তার মতো আরো অনেকেই ছেড়েছেন শীতলক্ষ্যার পাড়। তার ওপর এখন নতুন ভয় সাকার ফিশ। দেশীয় মাছ ধ্বংস করছে এই বিদেশি মাছ।প্রায় ৪০০ বছর আগে শীতলক্ষ্যা নদীকে ঘিরেই ব্যবসা-বাণিজ্যের শহর হিসেবে গড়ে উঠেছিল নারায়ণগঞ্জ। বর্তমানে শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ও আশপাশে ২০০ শিল্পকারখানা রয়েছে। তাছাড়া দূরবর্তী অনেক কারখানার পানিও ড্রেনের মাধ্যমে নদীতে ফেলা হচ্ছে। শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ডাইং কারখানাগুলোর রাসায়নিক বর্জ্য ও শহরের বর্জ্যরে কারণে নদীটির অস্তিত্ব বিলীন হচ্ছে।

নজরুল মাঝি বলেন, ‘শীতলক্ষ্যা নদী আছে ঠিকই, তয় নদীর জীবন নাই। কারণ শীতলক্ষ্যা নদীতে অহন কালো আর বিষাক্ত পানি। আমরা যখন নদীতে মাছ ধরতাম, তখন প্রায় সময়ই নদীর পানি খাইতাম। এহন তো নদীর পানি বিষ হইয়া গেছে। কেউ খাইলে রোগে ভুগবো। ১৫ বছর আগেও নদীতে মাছ আছিল, কিন্তু এহন তো নদীতে মাছ নাই। নদী তো ছাড়তে পারি না, তাই আমি এহন নৌকা চালাই। আমাগো জেলেপাড়ার অনেকে মাছ ধরা বন্ধ কইরা দিয়া গার্মেন্টসে কাম করে। যারা আছে তারা মেঘনাসহ অন্য নদীতে যায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘এহনো কিছু কিছু লোক এই নদীতে মাছ ধরতে আসে। তয় তারা মাছের চেয়ে অ্যাকুরিয়ামের মাছ বেশি পায়। কেমনে যে নদীতে এই মাছ আইলো? একদিকে কারখানার কালাপানি আরেক দিকে অ্যাকুরিয়ামের মাছ নদীটারে শেষ কইরা দিছে। তয় বর্ষাকালে পানি একটু পরিষ্কার হয়, আবার কয়েক মাস পরে কালা হইয়া যায়।’

শীতলক্ষ্যায় এখনো মাছ শিকার করেন স্থানীয় দুলাল। তিনি বলেন, ‘নদীতে জাল মারলেই তিন কাটার মাছ উঠে। এ গুলারে নাকি সাকার ফিশ কয়। কই থ্যাইকা আইলো এই মাছ? এগুলাতো কেউ খায় না। এই মাছ তো দেশীয় মাছ শেষ কইরা দিতাছে।’

এদিকে শীতলক্ষ্যা নদীতে দূষণ, আবর্জনা ফেলা বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে বিভিন্ন সংগঠন। তারা চান নদীটি যেন ফিরে পায় তার আগের রূপ। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি এ বি সিদ্দিক জানান, শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ও আশপাশে ২০০ শিল্পকারখানা রয়েছে। এছাড়া দূরবর্তী অনেক কারখানার পানিও ড্রেনের মাধ্যমে নদীতে ফেলা হচ্ছে। কারখানার বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই নদীতে পড়ে। শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ডাইং কারখানাগুলোর রাসায়নিক বর্জ্য ও শহরের বর্জ্যরে কারণে পানি দূষিত হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে কারখানাগুলোতে ইটিপি বসানো জন্য দাবি করছি আমরা। নগরীর কোনো বর্জ্য যেন নদীতে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া কারখানার ইটিপির মাধ্যমে পরিশোধিত পানি ফেলা হলে শীতলক্ষ্যাকে বাঁচানো সম্ভব।

সবুজ আন্দোলনের নারায়ণগঞ্জের সদস্য সচিব দিনা আমিন বলেন, ‘শীতলক্ষ্যা নদীকে দূষণ ও জলজ প্রাণীগুলোকে বাঁচাতে হলে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরো কার্যকরী ভ‚মিকা রাখা প্রয়োজন। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কী রেখে যাচ্ছি? আমরা একটা নদীর পরিবেশ ঠিক রেখে যেতে পারছি না।’

পরিবেশ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জের উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, আইন অনুযায়ী প্রতিটি ডাইং কারখানার ব্যবসায়ীরাই তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে ইটিপি স্থাপন এবং তা ব্যবহার নিশ্চিত করবে। যেসব প্রতিষ্ঠান ইটিপি ব্যবহার করছে না, নদীতে তাদের বর্জ্য ও রং মিশ্রিত পানি ড্রেনের মাধ্যমে ফেলছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

তিনি আরো জানান, নারায়ণগঞ্জে ৩২২টি প্রতিষ্ঠানে ইটিপি স্থাপন করা হয়েছে। আর ইটিপি নেই এমন ১১৮টি প্রতিষ্ঠান শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ইটিপি নির্মাণাধীন এবং ১০টির মতো কারখানা আপাতত বন্ধ রয়েছে। তবে আমরা সব প্রতিষ্ঠানকে বলেছি, ইটিপির মাধ্যমে পানি শোধন করে তা ফেলতে হবে।’

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ মইনুল হক জানান, শীতলক্ষ্যা নদীর দূষণ, জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী বাঁচানো একা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। শীতলক্ষ্যা নদীকে বাঁচাতে হলে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও জনসাধারণের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আয়নাল হক বলেন, ‘এই সাকার ফিশ খাওয়ার উপযোগী না। অন্য দেশ থেকে এই মাছগুলো আমাদের নদীতে চলে এসেছে। কোনোভাবেই এই মাছটিকে দমন করা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’

মন্তব্য

Beta version