বর্ষা মৌসুম আসন্ন। এর আগেই রাজধানীবাসীকে জলাবদ্ধতার হাত থেকে বাঁচাতে খাল উদ্ধার ও সংস্কারের কাজ হাতে নিলেও এর সুফল কতটা মিলবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিটি করপোরেশনের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের কাজ। কারণ ঢাকার খালগুলোর অনেকাংশ দখল করে স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করে ফেলেছেন অবৈধ দখলদাররা।
এদিকে দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
রাজধানী ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করার লক্ষ্যে কাজে নেমেই বাধার সম্মুখীন হলেও উচ্ছেদ অভিযানে ব্যাপক প্রশংসা পায় দুই সিটি করপোরেশন। বেশ কিছু অভিযানে সফল হলেও খাল উদ্ধার ও খনন সংস্কার কার্যক্রম বর্ষা মৌসুমেও শেষ করতে পারবে না বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আর এ কারণে এবারো রাজধানীবাসী সুফল পাবেন না বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, রাজধানীর ২৬টি খাল, ৩৮৫ কিলোমিটার স্টর্ম ওয়াটার ড্রেন, ১০টি বক্স কালভার্ট ও ডিএসসিসির ৯৫০ কিলোমিটার ড্রেন, ডিএনসিসির ১২৫০ কিলোমিটার পাইপ এবং ৯২টি হট স্পট চিহ্নিত নর্দমা দেখভাল করার দায়িত্ব পায় দুই সিটি করপোরেশন।
স্থানীয় সরকার বিভাগ ও ঢাকা ওয়াসার মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর এই দায়িত্ব পায় দুই সিটি। দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর থেকে এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় উদ্ধার অভিযানে নামে সংস্থা দুটি। সব মিলিয়ে মোট ৮৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার খাল খননের দায়িত্ব পেয়ে উদ্ধার অভিযানে নামে দুই সিটি কর্তৃপক্ষ।
এর পরই ডিএনসিসি ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দিয়ে এর সীমানা নির্ধারণ কাজ শুরু করে। উদ্দেশ্য রাজধানী ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসন পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনা এবং ঢাকাকে একটি আধুনিক শহর হিসেবে গড়ে তোলা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রকৌশলী বিভাগ বলছে, বর্তমানে ডিএসসিসির আয়তন ১০৯ দশমিক ২৫ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে হাজারীবাগ (কালুনগর খাল), ধানমন্ডি লেক, রামপুরা খাল, জিরানী খাল (খিলগাঁও-বাসাবো খাল), মাণ্ডাখাল (বেগুনবাড়ি খাল), ওয়ারী খাল, ওয়াপদা খাল, কাজলা খাল, ডিঅ্যান্ডডি রোড সাইড খাল, কুতুবখালী খাল, ঢাকা-চট্টগ্রাম রোড সাইট খাল এবং শ্যামপুর খাল পড়েছে ডিএসএসসিসির মধ্যে।
এছাড়াও খাল বন্ধ করে তৈরি করা বক্সকালভার্ট-পান্থপথ, পরীবাগ, খিলগাঁও বাসাবো, সেগুনবাগিচা, ধোলাইখাল রয়েছে এই এলাকায়। পানি নিষ্কাশনের জন্য ডিএসসিসি বর্তমানে এসব খাল ও বক্সকালভার্টের রক্ষণাবেক্ষণ খুবই জরুরি।
এসব খালের মধ্যে ডিএসসিসি মান্ডা, জিরানী, হাজারীবাগ ও শ্যামপুর খাল খনন করে আধুনিকায়ন করার লক্ষ্যে ৫ বছর মেয়াদি (সেপ্টেম্বর ২০২১ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪) ৯৪৫ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করলেও তা আজও অনুমোদন করেনি পরিকল্পনা কমিশন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রকৌশল বিভাগ বলছে, ১৯৬ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে ডিএনসিসি গঠিত। এ এলাকায় প্রায় ৩০টি খাল রয়েছে।
সেগুলোর মধ্যে রয়েছে কাঁটাসুর খাল, রামচন্দ্রপুর খাল, কল্যাণপুর প্রধান খাল, কল্যাণপুর ক খাল, কল্যাণপুর খ খাল, কল্যাণপুর ঘ খাল, কল্যাণপুর ঙ খাল, কল্যাণপুর চ খাল, রূপনগর প্রধান খাল, রূপনগর শাখা খাল (আরামবাগ), রূপনগর শাখা খাল (দুয়ারীপাড়া), রূপনগর শাখা খাল (চিড়িয়াখানা), মিরপুর দিয়াবাড়ি খাল, ইব্রাহীমপুর খাল, বাউনিয়া খাল, আব্দুল্লাহপুর খাল, দ্বিগুণ খাল, ধউর খাল, বাইশটেকি খাল, সাংবাদিক কলোনি খাল, কসাইবাড়ি খাল, মহাখালী খাল, উত্তরা দিয়াবাড়ি খাল, বেগুনবাড়ি খাল, শাহজাদপুর খাল, সূতিভোলা খাল, ডুমিনি খাল, বোয়ালিয়া খাল, গোবিন্দপুর খাল ও নরাই খাল।
এরই মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী খালগুলোর সীমানা পিলার স্থাপন কাজ শুরু করেছে।
অবৈধ দখলদারদের কাছ থকে খাল উদ্ধার অভিযানকালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, খালের সব কার্যক্রম শেষ হলে নগরবাসীর ভোগান্তি অনেকটা কমে আসবে। ইতিমধ্যেই খাল, নর্দমা ও বক্সকালভার্টগুলো পরিষ্কারের কাজ চলমান রয়েছে। খালের দখল উচ্ছেদের পর খনন করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দায়িত্ব পাওয়ার পর ডিএনসিসি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। খালের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ, পরিষ্কার এবং খননকাজ শুরু হয়েছে। এটা অব্যাহতভাবে চলবে।
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে অতীতে ঢাকা ওয়াসা তড়িৎ পদক্ষেপ নিয়ে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছিল। তাই আমি মনে করি দুই সিটির খালগুলো উদ্ধারে একটি সমন্বিত এবং প্রাক সমীক্ষা নির্ভর একটা সার্বিক পরিকল্পনা করা দরকার।
তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণ করছে তা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। তবে কাজগুলো আরো দ্রুত গতিতে হওয়া উচিত ছিল। কারণ বর্ষা মৌসুম প্রায় চলেই আসছে। তিনি বলেন, দুই সিটির খাল দেখভালের দায়িত্ব হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক।
এ বিষয়ে যাত্রাবাড়ী কাজলা খাল পাড়ের বাসিন্দা আমির আলী বলেন, ‘খাল পরিষ্কারের কথা কাগুজেই মনে হয় আমার। দেখুন, কাজলা ফ্লাইওভারের গোড়া থেকে মাদ্রাসা রোড পর্যন্ত ময়লা ফেলে ভরে ফেলা হয়েছে।’
তিনি বলেন, মাঝেমধ্যে এসে তা পরিস্কার করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পর আবার যা তাই হয়ে যায়। ফলে এই খাল এখনো পরিষ্কারই হচ্ছে না। এই বর্ষার আগেও এটা শেষ হবে বলে মনে হয় না।
এ বিষয়ে ডিএনসিসি এলাকার মিরপুরের গুদারাঘাট এলাকার বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘উত্তরের খালগুলোর সীমানা নির্ধারণ করতেই সময় যাচ্ছে। আমার মনে হয় না আসন্ন বর্ষায় এর সুফল মিলবে। তবে উত্তরের খালগুলো উদ্ধার হলে শতভাগ উপকৃত হবে উত্তরের মানুষ।’
মন্তব্য