বাথরুম ফিটিংসের শত শত দেশীয় কারখানায় প্রতিদিন প্রায় ৫০ টন পিতলের চাহিদা রয়েছে। স্থানীয়ভাবে ও ফেরিওয়ালাদের মাধ্যমে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ টন পিতল সংগৃহীত হয়। বাকিটা পূরণ হতো চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে গড়ে ওঠা শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে।
কিন্তু চট্টগ্রামের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে পাওয়া পিতলগুলো এখন ভারতে চলে যাচ্ছে। ফলে দেশের কারখানাগুলোয় পিতল সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণে অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এর ফলে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
চট্টগ্রামের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোয় জাহাজের প্রপেলার, পাইপ ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ২ থেকে ৩ হাজার টন তামা ও পিতল বের হয়। এর মধ্যে তামা-পিতল বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী সাইজ করে কেটে বিশ্বের প্রায় ১০টি দেশে রপ্তানি করে দেশের হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশে তামা-পিতল রপ্তানি হয়, সে দেশগুলো হলো- ভারত, চীন, হংকং, ফিলিপাইন, আরব আমিরাত, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি, ইংল্যান্ড, স্পেন ও গ্রিস।
১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ থেকে পিতল রপ্তানি শুরু হলেও ব্যাপক হারে রপ্তানি হচ্ছে ২০০৫ সালের পর থেকে। এর আগে ভারতে অবৈধভাবে পাচার হতো এই পিতল। অবশ্য এখন ভারতের ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রামের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে উচ্চমূল্যে পিতল কিনে কনটেইনারে সড়ক পথে নিয়ে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম থেকে প্রতি কনটেইনারে ২০ টন করে পিতল যাচ্ছে ভারতে। পিতলের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ভারতের ব্যবসায়ীরা বর্তমানে প্রতি কেজি পিতল কিনে নিচ্ছেন ৭০০ টাকা থেকে ৭৫০ টাকায়।
দেশের বাথরুম ফিটিংস কারখানা চালু রাখতে এতবেশি দামে পিতল কিনে কম দামে নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন মালিকরা। এর ফলে লাগাতার ক্ষতির মুখে পড়ে অধিকাংশ বাথরুম ফিটিংস কারখানা এখন বন্ধের পথে।
এভাবে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চড়ামূল্যে পিতল কিনে বিপাকে পড়ে যাচ্ছেন দেশের বাথরুম ফিটিংস কারখানার মালিকরা। কারণ তাদের উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়েনি। কিন্তু বেড়ে গেছে উৎপাদন খরচ।
এ কারণে লোকসান দিতে দিতে অনেক কারখানা মালিকই আস্তে আস্তে নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। এরফলে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে বাথরুম ফিটিংস পণ্যগুলো দেশে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে এ পণ্যগুলো দেশের চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে আমদানি করা ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না।এসব কারণে দেশে গড়ে ওঠা পিতলনির্ভর কারখানার মালিকরা আগে দেশের চাহিদা পূরণ করার বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে দাবি তুলে আসছেন। তারা বলেন, সহনশীল দামে পিতল পাওয়া গেলে দেশে গড়ে ওঠা বাথরুম ফিটিংস ও ঘর সাজানোর সামগ্রী তৈরির কারখানাগুলো আরো সমৃদ্ধ হবে।
এখানে আরো বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। একইসঙ্গে এসব কারখানা থেকে সরকার বিপুল রাজস্ব সংগ্রহের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারবে। কিন্তু অধিক মুনাফার আশায় ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছে উচ্চমূল্যে পিতল বিক্রি করে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের মালিকরা নিজেরা লাভবান হলেও দেশের বৃহৎ ক্ষতি হচ্ছে।
তারা অবিলম্বে দেশের চাহিদা পূরণ না করে দেশের বাইরে পিতল বিক্রি ও পাচার বন্ধের আহ্বান জানান। তবে সীতাকুণ্ড থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বর্তমানে ভারতে পিতল পাচার হওয়ার কোনো তথ্য আমাদের জানা নেই। এ-সংক্রান্ত কোনো অভিযোগও নেই থানায়। এমনকি কোনো আটকের ঘটনাও নেই।’
সীতাকুণ্ডের স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘একসময় ভারতে তামা-পিতল পাচার হলেও এখন আর পাচার হয় না। সরকার তামা-পিতল রপ্তানি করার অনুমোদন দেওয়ার পর থেকে পাচার বন্ধ হয়ে গেছে।
ভারতে তামা-পিতলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই এখন ভারতের ব্যবসায়ীরা সীতাকুণ্ডে এসে স্থানীয় বাজার মূল্যের চেয়ে একটু বেশি দামে পিতল ক্রয় করে কনটেইনারের মাধ্যমে সড়ক পথে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় তারা শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে সরাসরি কিনে নিচ্ছে।
আবার কখনো স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনে নিচ্ছে। তারা বেশি দামে কিনে নেওয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও দেশের বাথরুম ফিটিংস কারখানার চাহিদা পূরণ না করে ভারতের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। এর ফলে দেশের বাথরুম ফিটিংস কারখানাগুলো এখন তাদের চাহিদা অনুযায়ী পিতল পাচ্ছে না।’
সীতাকুণ্ডের আরএ শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের ম্যানেজার মো. তসলিম উদ্দিন বলেন, ‘সীতাকুণ্ডে আগে ২৫৮টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড ছিল। এর মধ্যে বর্তমানে ৩০ থেকে ৪০টি ইয়ার্ড চালু রয়েছে। বাকিগুলো ব্যাংকের দেনাসহ আর্থিক সংকটে পড়ে বন্ধ রয়েছে।
সম্ভাবনাময় এ জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে সরকার প্রচুর রাজস্ব পেয়ে থাকে। যখন একটি জাহাজ আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে ক্রয় করে দেশের অভ্যন্তরে আনা হয়, তখন সরকারকে পুরো জাহাজের ভ্যাট ও ট্যাক্স প্রদান করা হয়।
এরপর ইয়ার্ডে যখন জাহাজ কেটে স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করা হয়, তখনো সরকারকে ভ্যাট ও ট্যাক্স দেওয়া হয়। এরপর ইয়ার্ড মালিক জাহাজের স্ক্র্যাপ ও আসবাবপত্র বিক্রি করে লাভের মুখ দেখেন।
তিনি বলেন, ‘পরিবেশ বিপর্যয়ের অজুহাতে আমাদের দেশে যখন এই জাহাজ ভাঙা শিল্পকে বন্ধ করে দেয়ার পাঁয়তারা ও ষড়যন্ত্র চলে, তখন ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ এ শিল্পকে আরো বড় পরিসরে বাড়ানোর চেষ্টায় লিপ্ত।
ওই দেশগুলো এই জাহাজ ভাঙা শিল্পের পরিধি আরো বাড়াতে ভ্যাট ও ট্যাক্স মওকুফ করে দিয়েছে। তাই আমাদের দেশে যাতে এ শিল্প আরো ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে, সেই চেষ্টাই সবার করা উচিত। কারণ এ শিল্পের সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ জড়িত। এজন্য এই জাহাজ ভাঙা শিল্পকে সবার স্বার্থে বাঁচাতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আগে এইশিল্পকে ঘিরে পাচারকারী চক্র সক্রিয় থাকলেও এখন তামা-পিতলসহ কোনো কিছুই আর পাচার হয় না। শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে স্বচ্ছ টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্ক্র্যাপ লোহা ও তামা-পিতলসহ সব আইটেম বিক্রি করা হয়।
বিক্রি করার সময় ভ্যাট-ট্যাক্স কেটে নেয়া হয়। এখন সরকার তামা ও পিতল বিদেশে রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে। বিশ্বের ১০টি দেশে এখন রপ্তানি হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তামা-পিতল যাচ্ছে প্রতিবেশি দেশ ভারতে।
তাদের সঙ্গে সড়ক পথে যোগাযোগ রয়েছে আমাদের। এখন ভারতের ব্যবসায়ীরা সীতাকুণ্ডে এসে তামা-পিতল উচ্চমূল্যে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ তাদের দেশে তামা-পিতলের চাহিদা অনেক বেশি।’
তিনি জানান, ভারতের ব্যবসায়ীরা শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোর টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশ নিতে পারে না। তারা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বেশি দামে তামা-পিতল ক্রয় করে সড়ক পথে ভারতে নিয়ে যায়।
বর্তমানে তামা প্রতি কেজি ৮০০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা দরে এবং পিতল ৭০০ টাকা থেকে ৭৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। নরওয়ে, জার্মান ও বুলগেরিয়ার জাহাজ থেকে বেশি তামা ও পিতল বের হয়।
এ ছাড়া যেকোনো দেশের তেলবাহী জাহাজ অর্থাৎ অয়েল ট্যাংকার থেকে বেশি পাওয়া যায় তামা ও পিতল। ছয় বার জাতীয় রপ্তানিতে স্বর্ণ ট্রফি অর্জন করা দেশের বৃহত্তম স্ক্র্যাপ প্রপেলার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মেরিন সেফটি সিস্টেমের চেয়ারম্যান গাজী মোকাররম আলী চৌধুরী বলেন, ‘২০০৩ সাল থেকে আমরা লোহাহীন ধাতব স্ক্র্যাপ এবং তামা, পিতল, ব্রোঞ্জ, কাপ্রো-নিকেল, লাল পিতল এবং স্টেইনলেস স্টিল নিয়ে ব্যবসা শুরু করি।
বর্তমানে আমাদের রপ্তানির মূল্য ৩০ মিলিয়ন ডলারের। আমাদের প্রতিষ্ঠান মেরিন সেফটি সিস্টেম রপ্তানি করে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য এবং অঙ্গপ্রতিষ্ঠান নিআলকো অ্যাল্যাস লিমিটেড ১০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য বছরে রপ্তানি করে।
আমরা বাংলাদেশের স্ক্র্যাপ প্রপেলারের ৬০-৭০ শতাংশ রপ্তানি বাজার কাভার করছি। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠান শতভাগ রপ্তানিমুখী। তাই দেশের কোনো শিল্প কারখানায় আমরা তামা ও পিতল বিক্রি করি না।
একটা কথা যোগ করতে চাই, আমরা যদি এসব ধাতব স্ক্র্যাপ রপ্তানি না করি, তবে এগুলো ভারতে পাচার হয়ে যাবে। এর আগেও হয়েছিল। স্ক্র্যাপ ধাতুর ক্ষেত্রে ভারতে দেশি ব্যবহার ও রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই ভালো বাজার রয়েছে।
যখন আমরা লোহাবিহীন ধাতব স্ক্র্যাপ এবং লোহার পাত রপ্তানি শুরু করি তখন চোরাচালান কিছুটা কমে। আর এখন তো এ শিল্প থেকে সরকার প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।
সরকার যদি স্ক্র্যাপের সরাসরি রপ্তানি নিষিদ্ধ করে এবং প্রক্রিয়াজাত করার পরে এই স্ক্র্যাপ রপ্তানি করা বাধ্যতামূলক করে, তবে এ খাতটি আরো প্রসারিত হবে।
এতে প্রচুর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। সরকার আরো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভাল দাম হওয়ায় স্ক্র্যাপ থেকে প্রক্রিয়াজাত করে ধাতব পাত রপ্তানি এখন আরো বেশি লাভজনক।’
মন্তব্য