চট্টগ্রামের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। বিষাক্ত রাসায়নিকের ক্রিয়ায় কিংবা দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু এই জাহাজ ভাঙা শিল্পে যেন স্বাভাবিক ঘটনা। অধিকাংশ সময়ই শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে দুর্ঘটনা এবং হতাহতের খবর ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
তারপরও হতাহতের যে খবর প্রকাশ হয়ে যায়, তার পরিসংখ্যানও বেশ ভয়াবহ। গত ১৬ বছরেই এই শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে দুর্ঘটনায় ২২৮ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে এবং আহত হয়েছেন আরো সহস্রাধিক শ্রমিক।
জানা যায়, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ফৌজদারহাট থেকে কুমিরা পর্যন্ত এলাকাজুড়ে গড়ে উঠা শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে ২০২১ সালে দুর্ঘটনায় ১২ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও ২০২০ সালে ছয়জন, ২০১৯ সালে ২০ জন ২০১৮ সালে ১৮ জন, ২০১৭ সালে ১৫ জন ২০১৬ সালে ১৭ জন, ২০১৫ সালে ১৬ জন, ২০১৪ সালে ৯ জন, ২০১৩ সালে ১১ জন, ২০১২ সালে ২১ জন, ২০১১ সালে সাতজন, ২০১০ সালে ১১ জন, ২০০৯ সালে ২৫ জন, ২০০৮ সালে ১৪ জন, ২০০৭ সালে আটজন, ২০০৬ সালে ১০ জন এবং ২০০৫ সালে আটজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
এই শিপ ইয়ার্ডগুলোতে দুর্ঘটনার কারণগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শ্রমিকরা বেশির ভাগই বিস্ফোরণে কিংবা জাহাজ থেকে বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে আসার পর মারা যান। এছাড়াও কার্বন মনোক্সাইডের মতো বিপজ্জনক পদার্থে শ্বাস ফেলা বা কোনো সুরক্ষা না থাকায় ডিজেজিং উচ্চতা থেকে পড়ে যাওয়ার মতো দুর্ঘটনাগুলো প্রধান কারণ।
কর্মক্ষেত্রে হতাহতের অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে স্টিলের মরীচা ও ভারী প্লেট, পাশাপাশি সিলিন্ডার, বয়লার এবং জেনারেটরের বিস্ফোরণ এবং বৈদ্যুতিক শকে মৃত্যু। ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগত কারণে চট্টগ্রামের এই ইয়ার্ডগুলোতে বড় জাহাজ কাটা সুবিধাজনক হওয়ায় বিশ্বের অনেক বড় বড় জাহাজ এখানেই কাটা হয়।
কিন্তু বড় বড় জাহাজ কাটার জন্য যে ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা অপরিহার্য, এখানে তা ব্যবহার করা হয় না। এর মূল কারণ, মালিকেরা চান কম বিনিয়োগে অধিক মুনাফা। জাহাজ ভাঙা শিল্পের মালিকেরা টাকার পাহাড় গড়লেও শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তাসংক্রান্ত কোনো বিষয়ই মালিকপক্ষের কাছে কখনোই গুরুত্ব পায়নি। এজন্যই হতাহতের ঘটনা এত বেশি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম জেলার সাবেক সভাপতি ফজলুল কবির মিন্টু বলেন, ‘জাহাজ কাটার আগে বর্জ্য, বিষাক্ত গ্যাস ও বিস্ফোরকমুক্ত করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। এ কারণে প্রতিনিয়ত মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকেরা কাজ করছেন।
বছরের পর বছর জাহাজ ভাঙা শিল্পে দুর্ঘটনা এবং শ্রমিকের মৃত্যুর হার ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেলেও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।’
তিনি বলেন, ‘শ্রম আইনের ৯০ (ক) ধারা অনুযায়ী বাধ্যতামূলক হলেও এখনো কোনো ইয়ার্ডে সেফটি কমিটি গঠন করা হয়নি। ফলে প্রতিনিয়ত মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকরা কাজ করছে। জাহাজ ভাঙা শ্রমিকদের কর্মস্থান আজ কবরস্থানে পরিণত হয়েছে।
জাহাজ ভাঙা শিল্পকে রক্ষা ও টেকসই করার স্বার্থে শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের মৃত্যুর মিছিল এখনই থামাতে হবে এবং গড়ে তুলতে হবে দুর্ঘটনামুক্ত নিরাপদ শিপইয়ার্ড।’ একই প্রসঙ্গে এনজিও সংস্থা ইপসার সমন্বয়ক মুহাম্মদ আলী শাহিন বলেন, ‘আমদানি করা জাহাজগুলোর কাঠামোগত জটিলতার কারণেই জাহাজ ভাঙা একটি জটিল প্রক্রিয়া।
তাই বৈজ্ঞানিক উপায়ে জাহাজ ভাঙা সম্পন্ন করা উচিত। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ শিপইয়ার্ডে পরিবেশ সুরক্ষা, সঠিক বর্জ ব্যবস্থাপনা ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব জাহাজ ভাঙা শিল্পে শ্রমিকদের দুর্দশা বাড়িয়ে তুলেছে।’
তিনি বলেন, ‘আশার কথা হচ্ছে, কয়েকজন প্রগতিশীল মালিক এই শিল্পের ভাবমূর্তি পরিবর্তনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে শুরু করেছেন। এর মধ্যে একটি ইয়ার্ড গ্রিনইয়ার্ড হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। বেশ কয়েকজন শিল্প মালিকও সেই পথ অনুসরণ করছেন।
জাহাজ-ইয়ার্ডগুলো যদি গ্রিন শিপইয়ার্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং এখানকার আইনগুলো যদি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে দুর্ঘটনারোধ করা সম্ভব।’ জাহাজ ভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের আহ্বায়ক তপন দত্ত বলেন, ‘২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে কমপক্ষে জাহাজ ভাঙা শিল্পের দুই শতাধিক শ্রমিক গুরুতর আহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশ পঙ্গু হয়ে বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
২০২১ সালে ১২ জন শ্রমিক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৩০ জনের বেশি শ্রমিক। বছরের পর বছর জাহাজ ভাঙা শিল্পখাতে দুর্ঘটনা এবং শ্রমিকের মৃত্যুর হার ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেলেও এর জন্য দায়ী মালিক বা সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
বাংলাদেশে বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো সুবিধাও জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকরা পাচ্ছেন না।’তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালে মজুরি বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই সেক্টরের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি মাসিক ১৬ হাজার টাকা এবং দৈনিক ৬১৫ টাকা ধার্য করা হয়।
শ্রম আইনের ১৪৮ ধারা অনুযায়ী এটা বাধ্যতামূলক হলেও মালিকেরা তা মানছেন না। জাহাজ ভাঙা শিল্পের মালিকরা এত বেশি প্রভাবশালী যে, তারা একের পর এক অনিয়ম করে গেলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো সাহসও কারো নেই।’
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু তাহের দাবি করে বলেছেন, ‘আগের চেয়ে জাহাজ ভাঙা শিল্পে শ্রমিক নিহত ও আহত হওয়ার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং উপকরণের ব্যবস্থা করায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘শ্রমিকরা অনেক সময় সেফটি উপকরণ ব্যবহার করতে চায় না। তখন আমাদের কিছু করার থাকে না। আর সড়ক দুর্ঘটনায়ও তো কত লোক মারা যায়। সে তুলনায় জাহাজ ভাঙা শিল্পে কাজ করতে গিয়ে নগণ্য সংখ্যক শ্রমিকই মারা যান। আমরা নিহত শ্রমিদের পরিবারপ্রতি ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিই। আহতদের চিকিৎসার জন্য আলাদা হাসপাতাল করেছি।’
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ১৯৬০ সালে জাহাজ ভাঙা শিল্পের গোড়াপত্তন। এমভি আলপাইন নামে একটি গ্রিক জাহাজ চট্টগ্রামের সমুদ্রসৈকতে বিকল হয়ে পড়লে স্থানীয় লোকজন ও স্টিল শ্রমিকরা তা টেনে সমুদ্রের তীরে এনে তা ভেঙে বিভিন্ন নির্মাণকাজে ব্যবহার উপযোগী করে তোলে।
সেই থেকে শুরু। এখন বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে রড এবং ইস্পাতের ৮৫ শতাংশ চাহিদা মেটায় এই জাহাজ ভাঙা শিল্প। ২০০৪ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছর বাংলাদেশ জাহাজ ভাঙা শিল্পে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে ছিল। তবে এখন ভারত সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে। তাই দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। এই ব্যবসার আকার প্রায় আট হাজার কোটি টাকা।
২০১১ মাসের মার্চে সরকার জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ ভাঙা ও জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজতকরণকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করে। সীতাকুণ্ডে বর্তমানে ৬০টির মতো শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড সচল রয়েছে। যদিও কাগজে-কলমে আছে দেড় শতাধিক। এসব কারাখানায় বছরে আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ ‘স্ক্র্যাপ’ জাহাজ কাটা হয়। এই শিল্পে কাজ করেন প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার শ্রমিক।
মন্তব্য