-->
রমজানের প্রথম দিন

রমরমা পুরান ঢাকার ইফতার বাজার

ইফ্ফাত শরীফ
রমরমা পুরান ঢাকার ইফতার বাজার
ফাইল ছবি: সংগৃহীত

‘বিশ টাকার সমুচা চল্লিশ টাকায় কিনছি। মুরগি আগে ছিল ২৮০ টাকা, আর অহন ৩৮০ টাকায় কিনতে হইতাছে। খাওনের দাম যদি না কমে তাহলে সাধারণ মানুষ কই গিয়া দাঁড়াইব। কী খাইব! সব জিনিসের দাম বাড়তি। খাবার জিনিস যদি কিছু কমাইতে পারত সরকারে, তাইলে সাধারণ মানুষ কিছু ইফতার খাইতে পারত।’ রমজানে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় আক্ষেপ ভরা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জের বাসিন্দা মো. রমজান মিয়া।

রোববার (৩ এপ্রিল) পবিত্র রমজানের প্রথম দিনে পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, দুপুরের পর থেকেই ইফতারকে ঘিরে সরগরম হয়ে ওঠেছে। এই ইফতার বাজারের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। ৩৬টি উপাদান ও ১৮টি মশলা দিয়ে তৈরি করা হয় এ খাবার। এর মধ্যে গরুর মগজ, গরুর কলিজা, মুরগির মাংসের কুঁচি, সুতি কাবাব, মাংসের কিমা, ডিম, আলু, ঘি, বুটের ডাল এবং চিড়া অন্যতম। আর খাশির মাংস দিয়ে তৈরি সুতি কাবাব ১২শ' টাকা এবং গরুর মাংসের তৈরি কাবাব বিক্রি হচ্ছে এক হাজার টাকায়।

# সুতি কাবাব প্রতি কেজি ১২শ টাকা# ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ প্রতি কেজি ৮শ টাকা

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই ইফতার বাজার বসার ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের হস্তক্ষেপেও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। দোকানিরা শঙ্কায় ছিলেন এবার ইফতার বাজার বসবে কি না। তখন বেলা আড়াইটা। দোকানিরা ইফতার সামগ্রী নিয়ে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছেন। ফুটপাত আর রাস্তা দখল করে যাতে দোকান বসানো না হয় সেটা তদারকি করতেই হাজির ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। কিন্তু দোকানি আর ক্রেতাদের উপস্থিতি ব্যাপক হওয়ায় একফাঁকে স্থান ত্যাগ করেন ম্যাজিস্ট্রেটসহ সংশ্লিষ্ট টিম। এরপরই পসরা নিয়ে বসেন দোকানিরা। মজাদার সব ইফতার সামগ্রী কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন ক্রেতারা। এর পরই ধুমচে বিক্রি শুরু হয়। মাথায় টুপি লাগিয়ে ইফতার বিক্রেতারা পসরা সাজিয়ে ক্রেতার অপেক্ষা করতে থাকেন। বেলা যতই গড়ায়, ততই বাড়ে ক্রেতার সমাগম। ফুটপাত, রেস্টুরেন্ট, পাড়া-মহল্লার গলিপথেও ইফতারির ছোট-বড় দোকান বসে। কোথাও কোথাও রাস্তা দখল করে বসানো হয়েছে ইফতারির দোকান। বাঁশ আর টেবিল বসিয়ে পুরো ফুটপাত দখলে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সর্বত্রই ক্রেতাদের আকর্ষণে চলছে বাহারি রং আর স্বাদের ইফতারি আইটেম তৈরির প্রতিযোগিতা। দুপুর থেকে ইফতারির আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পুরো রাজধানী ইফতারের নগরীতে পরিণত হয়।

করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর ইফতার বাজার একেবারেই মন্দা গেছে। কিন্তু এবারের রোজায় পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক। সব মিলে এবার ইফতার বাজার গত দুইবারের তুলনায় ভালো যাবে বলে আশা করছেন বিক্রেতারা।

রোজাদারদের ইফতারের আয়োজন করতে রাজধানীজুড়ে এখন এক ধরনের উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। এবার রোজা গরমের সময় হওয়ায় ইফতারিতে বিভিন্ন পদ যোগ হচ্ছে। চকবাজারের ইফতারির দোকানের মধ্যে আলাউদ্দিন, আপেল কনফেকশনারি এবং আনন্দ অন্যতম। ক্রেতার চাহিদা বুঝে এ বছর প্রস্তুতি নিয়েছেন দোকানিরা। আপেল কনফেকশনারির ম্যানেজার মো. কাউসার জানান, ইফতারির জন্য ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নেওয়া শেষ হয়েছে। গরমের কারণে এ বছর তালিকায় লেবু এবং টকজাতীয় কয়েকটি আইটেম যোগ হবে। এর মধ্যে দইবড়া বেশি বিক্রি হবে বলে আশা করছেন এই দোকানি। পাশাপাশি অন্যতম হলো সুতি কাবাব। তবে গরুর মাংস দিয়ে তৈরি এই কাবাব প্রতি কেজি ১ হাজার টাকা। আর খাশির মাংস দিয়ে তৈরি কাবাব ১২শত টাকায় বিক্রি করছেন হাজী নূর হোসেন। ৩০ বছর যাবৎ রমজানে এই সুতি কাবাব বিক্রি করছেন তিনি। শুরুতে ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি করলেও দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় ৩০ বছর পর এখন ১২শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

চকবাজারের ফুটপাতের দোকানদার মো হারুন জানান, গরুর মাংসের দাম বেশি। ফলে এই মাংস দিয়ে যেসব খাবার তৈরি হয়, সেগুলোর দাম একটু বেশি। তিনি জানান, চকবাজারের ইফতারিতে এমন কিছু পদ আছে যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এ ছাড়া এখানকার খাবারের মধ্যে এক ধরনের মুঘল আমলের নবাবি স্বাদ ও আমেজ রয়েছে। এখানকার ইফতারের দাম তুলনামূলক একটু বেশি। তবে ঐতিহ্যেরও একটা মূল্য আছে।

মিষ্টিজাতীয় ইফতারের মধ্যে রয়েছে চার কেজি ওজনের শাহী জিলাপি। প্রতি কেজির দাম ২০০ টাকা। আরো রয়েছে ছানার মিষ্টি, ফিরনি, মিষ্টি সিঙ্গাড়া, জর্দা। শরবতের মধ্যে রয়েছে কাশ্মীরি শরবত, বোরহানি, লাবাঙ, লাচ্ছি ও লেবুর শরবত।

চকবাজারের ঐতিহ্যবাহী ইফতারির নাম ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। ৩৬টি উপাদান ও ১৮টি মশলা দিয়ে তৈরি করা হয় এ খাবার। এটির প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য খাবারের মধ্যে রয়েছে আস্ত খাসির রোস্ট। দাম ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। খাসির রানের রোস্ট ১ হাজার টাকা, বিভিন্ন ধরনের কাবাব ৪০-৮০, টানা পরোটা ২০-৩৫, দইবড়া হাফ ১০০, ফুল ২০০ টাকা, হালিম বাটি ছোট ৩০০, মাঝারি ৫০০, বড় ১ হাজার টাকা। ডিমচপ ১৫-২৫, সমুচা ১৫-৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

চকবাজারের ইফতার বিক্রেতারা বড় বাপের পোলায় খায়, দইবড়া, সুতি কাবাব, ঝালফ্রাই, গরুর কালিয়া, হালিম, জালি কাবাব, টানা পরোটা, জাফরানি শরবত, মালাইসমুচা, মালাইচপ, শিক কাবাব, হালিম, ফুলুরি, খাসির রান, মুরগি, কোয়েল ও কবুতরের রোস্ট, পনিরের পেটিস ও রোল, চিকেন টোস্ট, ভেজিটেবল রোল, নিমকি, ছোলা বুট, কাঁচা বুট, কিমা পরোটা, সিঙ্গাড়া, সমুচা, বেগুনি, আলু ও ডিমের চপ, পেঁয়াজু, টিকিয়া, ঘুগনি ইত্যাদি পণ্য বিক্রি করছেন।

মন্তব্য

Beta version