-->
শিরোনাম

কাঠফাটা রোদে যানজটে নাকাল রাজধানীবাসী

রাজন ভট্টাচার্য
কাঠফাটা রোদে যানজটে নাকাল রাজধানীবাসী

রাজধানীর যানজট নিরসনে কোনো টোটকাই কাজে আসছে না। অন্তত দুই মাস ধরে যানজটের এই বেসামাল পরিস্থিতি। গতকাল মঙ্গলবারও গোটা রাজধানী যেন থমকে ছিল।

শেষ চৈত্রের কাঠফাটা রোদে নাকাল হতে হয়েছে সবাইকে। এক ঘণ্টার পথ অতিক্রম করতে সময় লেগেছে দুই থেকে তিন ঘণ্টারও বেশি।

যানজটে আটকে থেকে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে সংকটের প্রতিকার চেয়েছেন। দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

অথচ রাজধানীর যানজট নিরসনে গত দুই দশকে অসংখ্য পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর আগে সিঙ্গাপুরে ব্যক্তিগত গাড়ির নিবন্ধন বন্ধ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ওই দেশটির যানজট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছিল।

দেশে ২০০৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ২০ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনা (এসটিপি) প্রণীত হয়, যা ২০০৬ সালে অনুমোদন পায়। ওই পরিকল্পনায় ছোট গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করে বড় গাড়ি বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু তাও যে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি তার প্রমাণ ঢাকার স্থবির সড়কচিত্র।

স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (এসটিপি) পর ২০১৫ থেকে ২০৩৫ সালের কথা বিবেচনা করে গণপরিবহণ খাতের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য আরএসটিপি প্রণয়ন করে। এতে যেসব সুপারিশ দেওয়া হয়েছিল তা বাস্তবায়ন হয়নি।

সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক মানের বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘ সময় এ শহরের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ৭০টি পলিসি এবং ১০টি প্রস্তাব দেয়। তাও ঝুলে আছে।

এর বাইরে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ট্রাফিক বিভাগ, সিটি করপোরেশন, ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ড, সড়ক পরিবহণ মন্ত্রণালয়- বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটিসহ বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে যানজট নিরসনে নানামুখী পরিকল্পনার অভাব নেই।

স্থায়ী এই ব্যাধি নিরসনে বিশেষজ্ঞরাও পরামর্শ হিসেবে নানামুখী টোটকা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সংকট তিমিরেই রয়ে গেছে। এই শহরের রাস্তা সূর্যোদয় থেকে মাঝরাত পর্যন্ত ফাঁকা থাকে না। সড়কে শুধু গাড়ি আর গাড়ি।

প্রতিদিনের যানজটের দুর্ভোগ এখন চরম পর্যায়ে ঠেকেছে। কিন্তু সবার প্রশ্ন একটাই আর কত দিন? এই পরিস্থিতি থেকে কি মুক্তির কোনো পথ নেই?

পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইচ্ছেমতো গাড়ি রেজিস্ট্রেশন, পর্যাপ্ত রাস্তা না থাকা ও অপরিকল্পিত উন্নয়নই যানজটের মূল কারণ। অথচ এসব সমস্যা স্থায়ী হলেও নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেই।

তাই আগামী পাঁচ বছর অন্তত রাজধানীতে ব্যক্তিগত যানবাহন রেজিস্ট্রেশন না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তারা বলছেন, ঢাকার সড়কচিত্র উন্নত করতে সিঙ্গাপুরের মতো কঠোর ব্যবস্থার বিকল্প নেই।

নিত্যকার এই জনভোগান্তি নিরসনে উন্নত গণপরিবহণ সেবা নিশ্চিত করাসহ ফুটপাতকে হাঁটার উপযোগী করা ও সড়কের দুপাশে পার্কিং বন্ধ করাও জরুরি। মানুষের কর্মঘণ্টা বাঁচানোসহ ভোগান্তি হ্রাস ও অর্থনৈতিক ক্ষতি ঠেকাতে দ্রুত সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।

এসটিপি ও আরএসটিপিতে রাজধানীর মানুষের নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করতে ফুটপাতগুলো সচল করার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া আটটি রেডিয়াল রোড, তিনটি রিং রোড এবং গণপরিবহণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছে।

গণপরিবহণ বলতে মূলত রাজধানীর বাস সার্ভিসকেই বোঝানো হয়েছে। এজন্য সুপারিশ করা হয়েছে বাস রুট রেশনালাইজেশন কার্যক্রম বাস্তবায়নের। এ ছাড়া এসটিপির সুপারিশে আছে পাঁচটি মেট্রোরেল, দুটি বিআরটি, ছয়টি এক্সপ্রেসওয়ে, ২১টি ট্রান্সপোর্টেশন হাব নির্মাণ।

পরিকল্পনার কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে। কিছু পরিকল্পনাধীন। কিছু কবে হবে এর নিশ্চয়তা নেই। গত দুই দশকে রাজধানীর যানজট নিরসনের লক্ষ্যে সরকার ফ্লাইওভারসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, বহু প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলমান রয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার ইতোমধ্যেই বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেছে।

জানা যায়, ২০০৭ সালে রাজধানীর পরিবহণের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। প্রায় দেড় দশক পরে এসে বর্তমানে রাজধানীর পরিবহণের গড় গতি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে।সার্বিকভাবে বললে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যানজটে মানুষ যখন দিশেহারা। তবুও সড়কের একটি বড় অংশজুড়ে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালামাল লোড-আনলোড করা হচ্ছে; সড়কের ওপর গাড়ি পার্ক করে রাখা হয়েছে; আবার অনেকে সড়কের ওপরই পসরা সাজিয়ে বসেছে।

এসব সমস্যা জিইয়ে রেখে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে রাজধানীর যানজট কতটা নিরসন হবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। গত মঙ্গলবার সকাল থেকেই গতিহীন ছিল উত্তরা আব্দুল্লাহপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত সড়কে চলা যানবাহনগুলো।

এটুকু রাস্তায় গাড়ির চাকা ঘুরতে সময় নিয়েছে ঘণ্টারও বেশি। মধ্য দুপুরে শহরে রোদের তেজ কিছুটা কমলেও গরম কমেনি। কমেনি যানজটও। বরং সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমস্যা আরো বাড়ে। বাড়ে সড়কে অপেক্ষা।

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার বদরুল হাসান বলেন, ‘বিআরটি প্রকল্পের চলমান কাজের কারণে বিমানবন্দর থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত রাস্তা অনেকটাই সংকীর্ণ হয়ে গেছে।

আগে যেখানে চার লেনে গাড়ি চলত, এখন সেখানে সমপরিমাণ গাড়ি দুই লেনে চলছে। এ জন্য এখন উত্তরায় নিয়মিত যানজট থাকে। বিমানবন্দর থেকে জসীম উদ্দীন সড়ক মুখে একটি পরিকল্পিত ইউলুপ ছিল, যার কারণে গাড়ির চাপ থাকলেও কোথাও কোনো ক্রসিং পড়ত না। তাই গাড়ির জট তৈরি হতো না।

যানজটের কারণ জানতে চাইলে ট্রাফিক বিভাগের মিরপুর পল্লবী জোনের সহকারী কমিশনার মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় শহীদ আনোয়ার পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষার্থীদের গাড়ির চাপের কারণে ক্যান্টনমেন্টের প্রবেশমুখে যানজট তৈরি হয়েছে। এটার প্রভাব এসে পড়েছে পেছনের রাস্তাগুলোতে।

শুধু তাই নয়, সকাল থেকে রাজধানীর মতিঝিল, শাজাহানপুর, কাকরাইল, নয়া পল্টন, পুরানা পল্টন, খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা, বিজয় সরণি, গুলশান, লিংক রোড, শাহবাগ, কাওরান বাজার, মীরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় তীব্র যানজট দেখা যায়।

পুলিশ বলছে, এমনিতেই রমজানে ঢাকায় বাড়তি আয়ের আশায় মানুষ বাড়ে, তেমনি বাড়ে যানবাহনও। ধানমন্ডি থেকে খিলক্ষেত মোড় পর্যন্ত যানজট পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। এই দেড় কিলোমিটার রাস্তা যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টার বেশি।

করোনার কারণে শিক্ষা সেক্টরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবার রমজানে ঢাকাসহ সারাদেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে। ফলে যানজট আরো বেড়েছে। জানতে চাইলে বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্স ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিবচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, হাজারো সমস্যায় জর্জরিত এই শহর।

অথচ পরিকল্পনা অনুযায়ী শহরকে গড়ে তোলা হচ্ছে না। শত পরামর্শের ভিড়েও রাস্তায় মানুষের দুর্ভোগ কমানো যাচ্ছে না। অথচ একের পর এক নতুন নতুন যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হচ্ছে।

নগর বিশেষজ্ঞ নূরুল ইসলাম নাজেম বলেন, এই শহরে দুর্ভোগ আরো বেশি হওয়ার কথা। যা হচ্ছে তা খুবই কম। কারণ সবকিছু পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে করলে দুর্ভোগ হবে এটাই স্বাভাবিক।

এত সব প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও যানজট না কমার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, মেট্রোরেল হলে যানজট কমে যাবে এমন ধারণা করে লাভ নেই। এজন্য যানবাহন রেজিস্ট্রেশন কমাতে হবে, প্রাতিষ্ঠানিক বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি।

সেইসঙ্গে ঢাকামুখী মানুষের স্রােত কমানোর বিকল্প নেই। সেইসঙ্গে পরিকল্পনা অনুযায়ী যানজট নিরসনে সবগুলো প্রকল্প দ্রæত বাস্তবায়ন করতে হবে।

মন্তব্য

Beta version