বসবাসের অযোগ্য রাজধানীকে বাসের উপযোগী করে গড়ে তুলতে কাজ করছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এই প্রয়াসের অন্যতম হচ্ছে রাজধানীর দখল হয়ে যাওয়া খাল উদ্ধার অভিযান। ইতোমধ্যে রামচন্দ্রপুর খাল উদ্ধার করে চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। এর সুফল পেতেও শুরু করেছে এলাকাবাসী। ঢাকা ওয়াসা থেকে রাজধানীর খালগুলো সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তরের পর থেকেই উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রেখেছে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন। দুই মেয়রের সরাসরি তত্ত্বাবধানে চলছে এই উদ্ধার অভিযান কাজ। ফলে সব সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে সফলতার মুখ দেখেছে রামচন্দ্রপুর খাল। উদ্ধার হওয়া এই খালের নৌযান চলাচলের মধ্য দিয়ে সুফল পেতে শুরু করেছে এলাকাবাসী।
* সব খাল চলাচলের উপযোগী করা হবে : আতিক
* দুই সিটির খাল উদ্ধার অভিযান অব্যাহত
* খালসেবা চালু হলে কমবে যানজট
খালটির অবস্থান বছিলা এলাকায়। রামচন্দ্র খালটি বসিলা থেকে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার উদ্ধার করে নৌ-চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। এ পথের যাত্রীরা ইতোমধ্যে এর সুফল পেতে শুরু করেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, উদ্ধার করা রামচন্দ্র খাল দিয়ে চলছে নৌকা। এলাকাবাসী পারাপারে এখন এই খাল ব্যবহার করছে। প্রাথমিকভাবে রামচন্দ্র খাল দিয়ে তৈরি হয়েছে ২৯ কিলোমিটার নৌ-সংযোগ পথ। নৌকার যাত্রী আলী আকবর পিনু বলেন, রামচন্দ্র খালটি ছিল প্রভাবশালীদের দখলে। এটি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছিল ট্রাক স্ট্যান্ড ও অবৈধ স্থাপনা। তবে উচ্ছেদের পর আগের চেহারায় ফিরেছে খালটি। পানি প্রবাহ চলছে পাশাপাশি নৌকা চলায় বেশ আনন্দ লাগছে। এ সেবায় আমি খুশি। আর্থিক সাশ্রয় আর সময় বাঁচার ফলে জনগণ এর সুফল পাবে।স্থানীয়রা বলছে, বিলীন হয়ে যাওয়া রামচন্দ্র খাল দিয়ে আবারো নৌকা চলবে এমনটা ভাবা যেত না। ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট চালু হওয়ায় একদিকে যেমন চলছে নৌকা, নেই যানজট আবার অর্থ সাশ্রয়ের মাধ্যমে সময়ও বাঁচে। ঢাকায় ৭৭টির বেশি খাল সচল ছিল। চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল ওই খালগুলো। নৌকা, স্টিমার চলত সেসব নদী-খালে। সেসময় নৌপথে মালামাল পরিবহণ ও বাণিজ্যিক প্রসার ঘটে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপরূপ ছিল তখন ঢাকা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দখল আর দূষণে একে একে হারিয়ে যেতে থাকে খালগুলো। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে চিহ্নিত করা হয়েছে ৫৮টি খাল। এর মধ্যে ৩৭টি খালের ২৪৮ প্রভাবশালী ব্যক্তি ও অনেক অবৈধ স্থাপনার হাত থেকে মুক্ত করতে ক্ষমতা পেয়েছে সংস্থা দুটি। এর মধ্যে অস্তিত্বসংকটে থাকা ৫৩টি খাল উদ্ধার করে নদীর প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত করতেও কাজ করছে তারা। উদ্ধার-পরবর্তী বাকি খালগুলোর সীমানা জটিলতা আর আনুষঙ্গিক কাজের দোহাই দিয়ে খালগুলো সচল করতে বেশ সময় নিলেও রামচন্দ্র খালের ৪ কিলোমিটার খালের সুবিধা পাচ্ছেন নগরবাসী। মামুন নামে স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ৪৫ মিনিটের রাস্তায় মাত্র ৭ মিনিটে যাওয়া আমাদের জন্য ছিল স্বপ্নের মতো। উত্তরের মেয়র এই জায়গায় সফল বলে মনে করছি। ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, ঢাকার মানুষের সমস্যা সমাধানে সবটুকু কাজ করতে চাই। খালগুলোর সুবিধা পেতে সময় লাগছে ঠিকই। তবে আমাদের খালগুলো নিয়েই জনগণের প্রশংসা কুড়াবে এক সময়। ঢাকার খালগুলো আগের চেহারায় ফিরে আসলে শহরের যানজট কমাতে ভূমিকা রাখবে। তবে খাল পরিষ্কারের দায়িত্ব নিতে হবে আমাদেরই। খালের ভেতরে আর কেউ যেন কোনো বর্জ্য ফেলতে না পারে। অনান্য খালগুলোর উদ্ধার অভিযান চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তিনি আরো বলেন, মৃতপ্রায় জায়গাগুলো উদ্ধারে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে। খাল আগের রূপে ফিরিয়ে আনতে অনেক টাকার প্রয়োজন। রামচন্দ্রপুর খাল পুনরুদ্ধার হলে ওয়াকওয়ে, সাইকেল লেন ও খেলার মাঠসহ নির্মাণ করা হবে দৃষ্টিনন্দন পার্ক।নগর পরিকল্পনাবিদ এবং স্থপতি ইকবাল হাবিব মনে করেন, অবৈধ দখল হয়ে যাওয়া উদ্ধার করা কাজটি যদিও সহজ নয়। তবে সিটি করপোরেশনের মালিকানায় খালগুলো আসায় এর রক্ষাণাবেক্ষণ ভালো হবে। কিন্তু এ কাজে সফল হওয়ার জন্য, দীর্ঘমেয়াদি নগর পরিকল্পনা, সামাজিক ও প্রশাসনিক সক্ষমতা এবং সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। দীর্ঘ বছরে দখলে থাকা খালগুলোতে অবৈধ স্থাপনা, ময়লা বর্জ্যসহ স্থানীয় লোকের লোলুপ দৃষ্টিতে আটকে যাওয়া খালগুলো হারিয়েছিল খালগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ। খালগুলো যে নদীতে সংযুক্ত হবে তা হলোসোয়া পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ কাটাসুর ও রামচন্দ্রপুর খালটি কল্যাণপুর খাল হয়ে যুক্ত হবে তুরাগে। গাবতলী, দারুসসালাম, কল্যাণপুর, শ্যামলী, আদাবর, পীরেরবাগ, আগারগাঁও তালতলা, শেওড়াপাড়ার একাংশ, মাজার রোড, আনসার ক্যাম্প, লালকুঠি, টোলারবাগ, পাইকপাড়া, আহমেদাবাদ, শাহআলী বাগ, বড়বাগ, মণিপুর, মিরপুর-১, ২, ৬, ১১, ১২ নম্বর আবাসিক এলাকা, রূপনগর ও জাতীয় চিড়িয়াখানা এলাকার এ খালটিও তুরাগে যুক্ত হবে।মিরপুরের বাউনিয়া খালের সঙ্গে মিরপুরের সাংবাদিক কলোনি খাল, বাইশটেকি খাল ও মিরপুর হাউজিং এলাকার খালগুলো সংযুক্ত। সব মিলে এটি ১৪ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ লম্বা। দখলের কারণে বর্তমানে এই খালগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। এগুলোকে যুক্ত করে মিরপুরের পল্লবী, কালশী, মিরপুর ১০ নম্বর, ১৩ ও ১৪ নম্বর এবং মিরপুর ডিওএইচএস আবাসিক এলাকার সব নিষ্কাশন নালা খালের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তুরাগে মিলবে।উত্তরা ও বিমানবন্দর এলাকার সব নিষ্কাশন নালা যুক্ত হয়েছে ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ আবদুল্লাহপুর খালের সঙ্গে। খালটি উত্তরার কাছে টঙ্গী খালের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু তা এখন বিচ্ছিন্ন। আবদুল্লাহপুর খালের সঙ্গে টঙ্গী খালের সংযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে। ঢাকার একসময়কার অভিজাত আবাসিক এলাকা ধানমন্ডি এলাকার সব নিষ্কাশন নালার পানি ধানমন্ডি লেক হয়ে হাতিরঝিলে গিয়ে পড়ত। কিন্তু পান্থপথ সড়ক নির্মাণের সময় ধানমন্ডি লেক ও হাতিরঝিল বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। হাতিরঝিলের সঙ্গে সংযোগ হবে বালু নদীর। পুরান ঢাকা, জিরানী, মান্ডা, মেরাদিয়া-গজারিয়া, কসাইবাড়ি, শাহজাহানপুর, শাহজাদপুর, সুতিভোলা, ডুমনি, বোয়ালিয়া, রামপুরা, গোবিন্দপুর, সেগুনবাগিচা ও খিলগাঁও-বাসাবো খালগুলো সুবিধা মতো মিলবে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীতে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, ঢাকা শহরকে বাঁচাতে হলে যে কোনো উপায়ে ঢাকার খালগুলো উদ্ধার করতে হবে। পানিপ্রবাহের প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। না হলে এই শহরকে কেউ আর রক্ষা করতে পারবে না। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ৫৩টি খাল উদ্ধার করে নদী প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগ আসলেই জনগণের জন্য কাজে আসবে।
মন্তব্য