-->
শিরোনাম

রাজউকের জমিতে শ্রমিক লীগ নেতাদের বাজার

ইদ্রিস আলম
রাজউকের জমিতে শ্রমিক লীগ নেতাদের বাজার
দোকান বরাদ্দের নামে সিকিউরিটি বাবদ অগ্রিম এককালীন মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে তুরাগ থানা শ্রমিক লীগের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে। ছবি- ভোরের আকাশ

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) উত্তরার তৃতীয় প্রকল্পের ১৮ নম্বর সেক্টর। এখানে খালি প্লট দখল করে অবৈধ বাজার বসিয়েছে একটি অসাধু চক্র। যেখানে রয়েছে প্রায় ৮০টি দোকান। দোকানিদের দেওয়া তথ্যমতে, চাঁদার টাকা আদায় করেন রুস্তম ও আনোয়ার। মাঝেমধ্যে তাদের নিয়োজিত কর্মীরা চাঁদা আদায়ের কাজটি সম্পন্ন করে থাকেন। ৮০টি দোকানে দৈনিক গড়ে ২০০ টাকা হিসেবে প্রতিদিন ১৬ হাজার টাকা চাঁদা ওঠে। প্রতি মাসে চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। যা বছর ঘুরে দাড়ায় ৫৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা। মাসিক ভাড়া বাবদ প্রতিদিন উঠানো হয় এই টাকা।

শুধু তাই নয়, দোকান বরাদ্দের নামে সিকিউরিটি বাবদ অগ্রিম এককালীন মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে তুরাগ থানা শ্রমিক লীগের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে।

রাজউক সূত্রে জানা যায়, জায়গাটি উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পের আওতায় বাণিজ্যিক প্লট হিসেবে নির্ধারিত। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পের ১৮ নম্বর সেক্টরে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ‘অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্ট’ এলাকার পশ্চিম পাশে পঞ্চপট্টি নামক স্থানে এই অবৈধ বাজার গড়ে উঠেছে। অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলো, উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরে রাজউকের অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্ট প্রকল্পের পরিচালকের অস্থায়ী কার্যালয়ের সম্মুখেই অবৈধ এই বাজারটি। বাজারটিতে রয়েছে ছোট বড় সব মিলিয়ে প্রায় ৮০টি দোকান। যেখানে খাবার হোটেল, শাকসবজি, মাছের দোকান, সেলুন, দর্জির দোকান, ডেকোরেটর, উন্নতমানের কফিশপ ও চায়ের দোকান। এ ছাড়াও রয়েছে ভ্রাম্যমাণ দোকান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন দোকানি বলেন, বাজারটি দেখভাল করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫২নং ওয়ার্ড শ্রমিক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী, তার সহযোগী শ্রমিক লীগ নেতা আনোয়ার হোসেন ও তুরাগ থানা শ্রমিক লীগের সাবেক সভাপতি সামছুল হক।

অভিযোগ আছে, ওই বাজার থেকে ওঠা চাঁদার ভাগ যায় রাজউকের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতাদের কাছে। ছবি- ভোরের আকাশ

 

কীভাবে দোকানের ভাড়া তোলা হয় জানতে চাইলে একাধিক দোকানি জানান, ব্যবসার ধরন অনুযায়ী প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিয়ে থাকেন তারা। এই চাঁদা তোলেন রুস্তম ও আনোয়ার।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজউকের জমি দখল করে বাজার গড়ে তুলেছেন শ্রমিক লীগের এই নেতারা। অভিযোগ আছে, ওই বাজার থেকে ওঠা চাঁদার ভাগ যায় রাজউকের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতাদের কাছে।

রাজউকের জায়গার ওপর দোকান বসিয়ে কি বলে তারা ভাড়া তোলেন জানতে চাইলে ভোরের আকাশকে দোকানিরা বলেন, বাজার চালাতে নাকি অনেক জায়গায় টাকা দিতে হয় তাদের। এমন কথা বলে আমাদের কাছ থেকে চাঁদা উঠায়।

রাজউকের জায়গায় আপনারা কার অনুমতিতে বাজার বসালেন এমন প্রশ্নে ৫২নং ওয়ার্ড শ্রমিক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী ভোরের আকাশের প্রতিবেদকের কাছে প্রথমে অস্বীকার করেন। বলেন, মিথ্যা কথা- এগুলো উল্টাপাল্টা কথা। কোথায় পেয়েছেন বলে রেগে যান।

আমার কাছে প্রমাণ আছে বলতেই বলেন, দোকানদারদের সঙ্গে নিয়ে নিজেরাই তৈরি করেছি। আমরাই চালাই। আমার নিজেরও দোকান আছে এখানে।

এই চাঁদার টাকা কি শুধু আপনারাই নিয়ে থাকেন- না এর ভাগ অন্য কাউকে দিতে হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তো আপনাকে বললাম ভাই, কোনো চাঁদা উঠানো হয় না। পরে যখন বলা হয় চাঁদা উঠানোর ফুটেজ আছে তখন কথা ঘুরিয়ে বলেন ভাই আমি অসুস্থ। আপনি সরাসরি আসেন কথা বলি।

এই টাকাগুলো রাজউকে কোন পদ্ধতিতে জমা করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাজারে তিনজন নিরাপত্তাপ্রহরী এবং পানি ও বিদ্যুতের বিল বাবদ টাকা তোলা হয়। এই টাকার ভাগ অনেক জায়গায় যায় এতটুকুই বলতে পারি। কিন্তু জমার ব্যাপারে সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। এই চাঁদার টাকা কেন উঠায় আর কোথায় জমা রাখে তা জানতে সামছুল হকের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

চাঁদা ভাগাভাগির বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রমিক লীগ নেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা তো চুনোপুঁটি লোকালভাবে থাকি। ওপরে লোক আছে। বাজার তো আর একজনের নেতৃত্বে চলে না ভাই। পাশেই গড়ে ওঠা রাজউকের অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পে বসবাসকারীরা বলছেন, এই প্রকল্পে ৭৯টি বহুতল ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। সেখানে এখন বাস করে প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার মানুষ। প্রকল্পটির ভেতরে শুধু একটি সুপারশপ আছে। প্রকল্পটিতে কোনো কাঁচাবাজার না থাকায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বাজারটিতেই তারা বাজার করেন।

এদিকে রাজউক বলছে, উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পের বাণিজ্যিক প্লটের জমিতে গড়ে ওঠা অবৈধ বাজারটি এখন পর্যন্ত তিনবার উচ্ছেদ করা হয়েছে। প্রতিবার উচ্ছেদের পর নতুন করে দোকান বসেছে। উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পের পক্ষ থেকে সংস্থাটির এস্টেট ও ভূমি-১ শাখাকে বাণিজ্যিক ওই প্লট নিলামের মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ চিঠি দেওয়া হয় ১ ফেব্রুয়ারি।

প্রকল্পটির পরিচালক হাফিজুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আমি বেশ কয়েকবার উচ্ছেদের জন্য চিঠি দিয়েছি। কিন্তু রমজান মাস আর ম্যাজিস্ট্রটের সংকটের জন্য উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে খুব শীঘ্রই অভিযান চালানো হবে বলে জানান। ’

রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এই বাজার থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই কথা একদমই সত্য না। যদি সাহস থাকে রাজউকের কে জড়িত নাম বলতে বলেন ওদের। শুধু বাজারই না নার্সারিও উচ্ছেদ করা হবে। আমি এই বাজারের সঙ্গে অনেকেরই নাম শুনেছি, জানি না তাদের জোর কোথায়? অভিযান চালানোর সময় কারো অনুরোধ আমি শুনব না।’

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৫২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদ আহমেদ বলেন, এই বাজার নিয়ে কথা বলার কোনো এখতিয়ার সিটি কর্পোরেশনের নেই। এটি রাজউকের এরিয়া। এটা নিয়ে আমরা কোনো কথা বলতে পারি না। যা বলার রাজউক বলবেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) চেয়ারম্যান আমিন উল্লাহ্ নুরীকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

উল্লেখ্য, রাজউকের উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পটি নেওয়া হয় ১৯৯৯ সালে। এটি ২০১০ সালে শেষ করার কথা ছিল। তবে শেষ হয়নি। মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। রাজউক সূত্র জানায়, প্রকল্পটির মেয়াদ আগামী জুনে শেষ হবে।

মন্তব্য

Beta version