-->

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার এখনো অদ্বিতীয়

শিপংকর শীল
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার এখনো অদ্বিতীয়
এখনো পুরান ঢাকা মানেই সেরা আর বিখ্যাত খাবারের সমারোহ। এর মধ্যে রয়েছে বিউটি লাচ্চি, হাজির বিরিয়ানি, বাকরখানি, বড় বাপের পোলায় খায়, শরবত ইত্যাদি। ছবি- ভোরের আকাশ

কিছুতে তার নেইকো রুচি/ মণ্ডা মিঠাই ফুলকো লুচি/ কেক পেস্টি আইসক্রিম/ তেল মুড়ি কি ঝাল বাদাম/ যা খেতে দাও তাতেই বেজার/ এ রোগ সারে পড়লে পাতে চকবাজারের গোস্তরুটি। ছড়াকার আবদার রশিদ এভাবেই পুরান ঢাকার গোস্তরুটির স্বাদের বর্ণনা করেছেন। এই এক খাবারেই সীমাবদ্ধ নয়। পুরান ঢাকায় রয়েছে নানা রকমের খাবার। এসব খাবারের নাম শুনলে জিভে জল আসবেই। কত পদের যে সুস্বাদু খাবার, কত যে বাহারি নাম! সেই স্বাদ নিতে নানা জায়গা থেকে ভোজনপ্রেমীরা ভিড় জমান পুরান ঢাকার খাবারের হোটেল ও দোকানগুলোতে।

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারে সুনাম অল্পদিনের নয়। এখনো পুরান ঢাকা মানেই সেরা আর বিখ্যাত খাবারের সমারোহ। এর মধ্যে রয়েছে বিউটি লাচ্চি, হাজির বিরিয়ানি, বাকরখানি, বড় বাপের পোলায় খায়, শরবত ইত্যাদি।

সুলতানি, মোগল, নবাবি, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলের পর ৪০০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসেছে ঢাকার। ইতিহাসের কিছু কিছু অংশের প্রভাব কোথাও খুব বেশি, কোথাওবা একেবারেই নেই। ইতিহাস ও আধুনিকতাকে একসঙ্গে বয়ে চলেছে এই শহরের বিশেষ অংশ পুরান ঢাকা। এখানে ইতিহাস এখনো কথা বলে, ঐতিহ্য সগৌরবে মাথা উঁচু করে চলে।

পুরান ঢাকার খাবার নিয়ে কথা হবে আর বিরিয়ানি থাকবে না তা কী করে হয়! কাজী আলাউদ্দিন রোডে রয়েছে পুরান ঢাকা তথা ঢাকা শহরের অন্যতম হাজি বিরিয়ানি। ১৯৩৯ সালে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়। বিরিয়ানি রেস্তোরাঁগুলোর মধ্যে অন্যতম হাজি বিরিয়ানি। ১৯৩৯ সালে হাজি মোহাম্মদ হোসেন নামে একজন ব্যক্তি রাস্তার ধারের খাদ্য বিক্রির দোকান হিসেবে রেস্তোরাঁটি চালু করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে এর ব্যবসায় নাটকীয় পরিবর্তন মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি শহরের সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে।

এ বিষয়ে কাজী বিরিয়ানির ম্যানেজার মো. রহমত আলী ভোরের আকাশকে বলেন, এই ব্যবসাটি ১৯৩৯ সালে হাজি মোহাম্মদ হোসেন নামে একজন বাবুর্চি শুরু করেছিলেন। ১৯৯২ সালে হাজি মোহাম্মদ হোসেন মারা যাওয়ার পর, তার ছেলে হাজি মোহাম্মদ গোলাম হোসেন দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হাজি মোহাম্মদ গোলাম পারিবারিক ব্যবসা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ব্যবসাটি তার ছেলে হাজি মোহাম্মদ শাহেদের হাতে তুলে দেন। স্বাদ, দাম, ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার গুণে ইতোমধ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে এ খাবার। বর্তমানে এ খাবারের দাম রাখা হয় ২০০ টাকা।

বাকরখানি পুরান ঢাকার শুধু ঐতিহ্যবাহী খাবারই নয়, এটি এখানকার একটি স্বকীয় পরিচিতি। পুরান ঢাকাবাসীর সকাল-বিকালের চা-চক্র বাকরখানি ছাড়া জমেই না। খাবারটি এই অঞ্চলের নাশতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

বংশালে নুর আহমেদের বাকরখানির একটি দোকান রয়েছে। তিনি বলেন, পুরান ঢাকায় প্রায় ১৫০ বছরেরও বেশি সময় আগে ব্রিটিশ শাসনামলে এটি প্রতিষ্ঠা করেন মো. আবেদ রুটিওয়ালা। বর্তমানে তাঁর তৃতীয় প্রজন্ম এর দায়িত্বে রয়েছে। এখানে একইসঙ্গে ভালো মানের চা পাওয়া যায়। এই দোকানে চা-বাকরখানির একসঙ্গে স্বাদ নেওয়া যায়। এখানে আলাদাভাবে বাকরখানি কিনে চায়ের দোকানে গিয়ে বসতে হবে না। সব দোকানেই চিনি ছাড়া ও চিনিসহ দুই ধরনের বাকরখানি পাওয়া যায়। মূল্য প্রতি পিস পাঁচ টাকা।

১৯২২ সালে শুরু করেছিলেন লেবুর শরবত দিয়ে। পরে যুক্ত করেন লাচ্ছি। এরপর ফালুদা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আবদুল আজিজকে। দোকানের নাম রাখেন বিউটি লাচ্ছি অ্যান্ড ফালুদা। একনামে এখন সবাই চেনে এই দোকান।

আবদুল আজিজের হাত ধরে ব্যবসায় হাল ধরেন ছেলে গফফার মিয়া। ১৫ বছর আগে মারা যান গফফার মিয়া। তার উত্তরসূরি হিসেবে দোকানের হাল ধরেছেন ছেলে জাবেদ হোসেন।

বিউটি লাচ্ছির এই দোকান পুরান ঢাকার জনসন রোডে। তার পাশেই ঢাকার আদালতপাড়া। রোজ সকাল ৯টায় দোকান খোলে। বন্ধ হয় রাত ১২টায়। সব সময় ভিড় লেগেই থাকে। দোকানের সামনের অংশে লাচ্ছি বানানো হয়। পেছনে বানানো হয় ফালুদা। দোকানের ম্যানেজার মো. সানি বলেন, এখানে তিন পুরুষ ধরে লাচ্ছি-ফালুদা বিক্রি করে আসছি। এটার শুরু হয় আজিজ দাদার হাত ধরে।

লাচ্চি কিনতে এসেছেন প্রাণ বসাক। তিনি বলেন, ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে আসতেন লাচ্ছি খেতে। এখন প্রায় সময় লাচ্চি খেতে আসেন। মাঝে মধ্যে নিজে খেয়ে পরিবারের জন্য প্যাকেট করে নিয়ে যান। স্বাদের ক্ষেত্রে বিউটি লাচ্ছি একেবারে আলাদা।

দোকানের কারিগর জাকির হোসেন দীর্ঘদিন ধরে লাচ্ছি ও ফালুদা তৈরি করছেন। তিনি বলেন, ফালুদার প্রধান উপকরণ দুধের মালাই। লাচ্ছি কিংবা ফালুদা তৈরির উপকরণে কোনো কৃত্রিম রাসায়নিক উপকরণ ব্যবহার করেন না। এ কারণে বিউটির লাচ্ছি-ফালুদার এত নাম-ডাক।

‘বড় বাপের পোলা’ ইফতারিটি চকের প্রধান আকর্ষণ। জনপ্রিয় এই আইটেমটির আবিষ্কারক নিয়ে অনেকের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। কারো মতে এটি শত বছরের পুরোনো, আবার কারো মতে, বছর সত্তর আগে কামাল মাহমুদ নামের এক ভোজন রসিকই ‘বড় বাপের পোলা’র রেসিপি তৈরি করেন।

সেন্টু মিয়া নিজেও এ কাজ করছেন প্রায় বছর তিরিশেক। সেন্টু মিয়া জানান, পাকিস্তান আমলে এই আইটেম ‘সিক চূড়ার ভর্তা’ নামে পরিচিত ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলায় এটা ‘বড় বাপের পোলা’ নামে পরিচিতি পায়।‘বড় বাপের পোলা’ কিনতে আসা ক্রেতা মো. মহসিন বলেন, ‘প্রতিবার রমজানেই একবার হলেও এই খাবারটি বাড়ি নিয়ে যাই। এর স্বাদেই রয়েছে ভিন্নতা।’

‘বড় বাপের পোলা’ বিখ্যাত হওয়ার পেছনে রয়েছে এর আকার ও স্বাদ। এত সুস্বাদু হওয়ার কারণ হিসেবে জানা যায়, এই আইটেমে তৈরি প্রণালির ভিন্নতা। এতে ব্যবহৃত হয় ডিম, গরুর মগজ, আলু, ঘি, কাঁচা ও শুকনো মরিচ, গরুর কলিজা, মুরগির মাংসের কুচি, মুরগির গিলা কলিজা, সুতি কাবাব, মাংসের কিমা, চিড়া, ডাবলি, বুটের ডাল, মিষ্টিকুমড়াসহ ১৫ পদের খাবার আইটেম ও ২৪ ধরনের মসলা। সবকিছু একটি থালায় মাখিয়ে ঠোঙায় করে বিক্রি করা হয়। যদিও প্রথমদিকে কাঁঠাল পাতায় বিক্রি করা হতো সুস্বাদু এই ইফতার আইটেম।

মন্তব্য

Beta version