যানজট নিরসনে চলমান দুই মেগা প্রকল্পে মেয়াদ যেমন বাড়ছে, তেমনি মোটা অংকের ব্যয়ও বাড়ছে। মেট্রোরেল-৬ ও ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে মিলে ৮ হাজার ২২৬ কোটি টাকা বাড়তি ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এর মধ্যে মেট্রোরেলের ব্যয় বাড়ছে আট হাজার কোটি ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বাড়ছে ২২৬ কোটি টাকা। ২০২৫ সালের আগে শেষ হচ্ছে না প্রথম মেট্রোরেলের সব কাজ। তবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও ১১ কিলোমিটার অংশের উদ্বোধন হওয়ার কথা রয়েছে।
এদিকে চলতি বছরের জুনের পরিবর্তে ২০২৬ সালের জুনে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শেষ করা হবে বলে প্রকল্পসূত্রে জানা গেছে। যানজট নিরসনে সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক দুটি মেগা প্রকল্পের কাজ বারবার পেছানোর কারণে জনদুর্ভোগ যেমন বাড়ছে, তেমনি বারবার রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় না করে দ্রুততার সঙ্গে কাজ এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা।
জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, যোগাযোগ খাতের অগ্রাধিকারভিত্তিক বিভিন্ন প্রকল্পে দেখা যাচ্ছে নানা জটিলতার কারণে সময়মতো শেষ হচ্ছে না। তেমিন ব্যয়ও বাড়ানো হচ্ছে। এতে যে উদ্দেশ্যে প্রকল্প করা হয় তাতে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে।
মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তাই প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের সব সময় সদিচ্ছা থাকতে হবে যেন দ্রুততার সঙ্গে কাজটি সম্পন্ন করা যায়।
মেট্রোরেল প্রকল্পে ব্যয় বাড়ছে আট হাজার কোটি প্রস্তাবটি অনুমোদিত হলে মেট্রোরেলের মোট নির্মাণ ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা থেকে দাঁড়াবে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকায়। পাশাপাশি মতিঝিল থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত আরো ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বেড়ে মেট্রোরেলের আয়তন হবে ২১ কিলোমিটারের বেশি।
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুসারে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলমান প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রয়েছে। তবে তার আগেই গত বছর এর কাজ শেষ করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত অংশ বৃদ্ধি ও প্রকল্পের জন্য নতুন করে জমি অধিগ্রহণ এবং গ্রাহকসেবা আরো আধুনিক করতে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
সে ক্ষেত্রে প্রকল্পের পুরা কাজ শেষ করতে সময় লাগবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। মেট্রোরেলকে লাভজনক প্রকল্পে রূপান্তরিত করতে এর ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়া প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বাড়তি অংশে ভূমি অধিগ্রহণ, নির্মাণ এবং ই অ্যান্ড এম সিস্টেম সংগ্রহ করা হবে। পাশাপাশি ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্টের (টিওডি) জন্য ভূমি বরাদ্দ ও নকশা তৈরি, ট্রেন পরিচালনায় বিদ্যুৎ খরচ এবং এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সংগ্রহ করা হবে।
এ ছাড়া স্টেশনে যাত্রী ওঠানামার জন্য লিফট, এস্কেলেটর, সিঁড়ি, র্যাম্প, হাই রেজুলেশন সম্পন্ন ফেস ডিটেকটেড সিসি ক্যামেরা স্থাপন, ফুটপাত নির্মাণ এবং বয়স্ক, রোগী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য হুইলচেয়ারের ব্যবস্থার পাশাপাশি পরামর্শক ব্যয় এবং আনুষঙ্গিক কার্যক্রমের জন্যও ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জানতে চাইলে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এমএএন ছিদ্দিক বলেন, প্রকল্পে আমরা নতুন কিছু যুক্ত করতে যাচ্ছি। যা পূর্বের ডিপিপিতে ধরা ছিল না। আগে যেসব কম্পোন্যান্ট রয়েছে তার ডিপিপিতে একই থাকছে। শুধু নতুন করে যেসব বিষয় যুক্ত করা হচ্ছে তার ব্যয় বাড়বে।
তিনি আরো বলেন, মেট্রোরেল প্রকল্পের যখন ডিপিপি ধরা হয় তখন অনেক বিষয় এতে যুক্ত করা হয়নি। তখন ধরে নেওয়া হয়েছে ভবিষ্যতে নতুন করে কিছু যুক্ত করার প্রয়োজন হলে তখন তা যুক্ত করা হবে। কারণ আমরা গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী প্রকল্পের পরিধি নির্ধারণ করি। পৃথিবীর উন্নত দেশেও বিভিন্ন প্রকল্পে এমন ব্যয় যুক্ত করা হয়।
এই কর্মকর্তা বলেন, কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণসহ পুরো প্রকল্পে যাত্রীদের প্রবেশ, বের হওয়া এবং বিশ^মানের যাত্রী পরিষেবা দেওয়ার জন্য আমরা প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছি।প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাবের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বিদ্যমান গণপরিবহণ ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবহারবান্ধব মেট্রোরেল চালুর বিষয়টি মাথায় রেখে প্রবেশ ও বাহির হওয়ার পয়েন্টগুলো জনসাধারণের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যময় করা হবে। এ জন্য নতুন কাজের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন প্রস্তাবে মেট্রোরেলের স্টেশন প্লাজা এবং ট্রান্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্টকে (টিওডি) প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হবে। এখন মূল প্রকল্পের সঙ্গে এগুলোর সম্পর্ক নেই।
মূলত প্রস্তাবিত অতিরিক্ত কাজের জন্য ভূমি অধিগ্রহণে বেশি ব্যয় হবে। ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয় আগে দেড়গুণ ছিল। এখন এটা তিনগুণে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকা বিনিময় হারে পরিবর্তন এসেছে। সেখানে অতিরিক্ত অর্থ যাচ্ছে।
সিডি ভ্যাট বা উন্নয়ন প্রকল্পের মূসক ও শুল্ক হার পরিবর্তন হওয়ায় এ খাতেও ব্যয় বেড়েছে। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এক পয়সাও বেশি দেওয়া হবে না। ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ব্যয় বাড়ছে
রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের অসহনীয় যানজট নিরসনে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ চলমান অবস্থায় এ প্রকল্পের ব্যয় আরো ২৬২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বাড়ছে। পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়ও বাড়ছে চার বছর।
ইতোমধ্যেই প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বাড়ানোর প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। সেতু কর্তৃপক্ষের এই প্রস্তাবনা যাচাই-বাছাই করে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হবে।
২০১৭ সালের অক্টোবরে অনুমোদিত মূল প্রকল্পের ব্যয় ধরা ছিল ১৬ হাজার ৯০১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। যার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি অর্থ ঋণ দেওয়ার কথা বলেছিল চীন। যার অংক ছিল ১০ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা।
২৬২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা খরচ বাড়ানোর ফলে এখন প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ১৭ হাজার ১৬৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। তবে এক্ষেত্রে চীনের ঋণ আর বাড়ছে না।গব মিলিয়ে এক হাজার ৫৪২ কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় করবে সরকার।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের জুন মেয়াদে প্রকল্পের কাজ শতভাগ সম্পন্ন হওয়ার সময় নির্ধারণ ছিল। মেয়াদ চার বছর বাড়িয়ে এখন ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।প্রকল্পের সময়-ব্যয় বৃদ্ধি প্রসঙ্গে সেতু বিভাগের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) ওমর মো. ইমরুল মহসিন বলেন, চীন প্রথমে যে পরিমাণ ঋণ দিতে চেয়েছিল তা দেয়নি (এক হাজার ২৮০ কোটি কম দিয়েছে)। চীন শুধু টানেলে ১০০ শতাংশ ঋণ দিয়েছে।
প্রকল্প ঋণ কমার কারণে জিওবি খাত থেকে টাকা বাড়বে। এ জন্য প্রকল্পের ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) সংশোধন করতে হবে। ইতোমধ্যেই প্রকল্পের সংশোধন প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছি। প্রকল্পের ব্যয়ের সঙ্গে সময়ও বাড়বে।
মন্তব্য