রাজধানীজুড়ে বেড়ে চলেছে ব্যাটারিচালিত রিকশার আধিপত্য। বেপরোয়া গতির কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। তবু চলছে এই যাত্রী বাহনটি। এদের সংখ্যা গুণে শেষ করা মুশকিল। নিয়মের বালাই নেই; পরোয়াও নেই।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ব্যাটারিচালিত এমন রিকশা বেড়ে গেছে আগের তুলনায় কয়েকগুণ। রাজধানীর অলিগলি ছেড়ে এখন প্রধান সড়কও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই রিকশা।
কোথাও কোথাও প্রশাসনের কড়াকড়ি থাকলেও প্রতিবন্ধী এবং বয়স্ক হওয়ায় মানবিক কারণে পার পেয়ে যাচ্ছেন অনেক চালক। তবে ব্যস্ত সড়কে বিপজ্জনক এই যানটি এখন দুর্ঘটনার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সমন্বয় না থাকায় প্রতিদিনই এই বাহনটির সঙ্গে অন্য বাহনের সঙ্গে ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। পাশাপাশি সড়কে সৃষ্টি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা আর যানজট।
অনেকে বলছেন, পায়ে চালিত যানটি ব্যাটারি দিয়ে চলা মানেই বিপদ বেড়ে যাওয়া। দ্রত সময়ের মধ্যে রিকশা নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন। পরিস্থিতি বিবেচনায় এই যানটি বন্ধের পরামর্শ যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সচেতন নাগরিকদের।
সকাল থেকে নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত রিকশায় রাজধানীর মূল সড়কগুলো সয়লাব থাকতে দেখা যায়। ব্যাটারিচালিত এসব রিকশা চলাচল বন্ধ করতে পুলিশ মাঝে মাঝে তৎপর হয়, আটকও করে। তবু এই বাহনগুলোর চলাচল থেমে নেই, বা বন্ধ হচ্ছে না।
নগরীর খিলগাঁও, বনশ্রী, বাসাবো, মাদারটেক, মৌচাক, রামপুরা, ফকিরাপুল, মতিঝিল, বাড্ডা, নতুনবাজার, মীরপুর, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুরসহ কয়েকটি সড়কে এসব রিকশা চলাচল করতে দেখা গেছে। আগে ট্রাফিক বিভাগ অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা আটক করলেও এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই দাপিয়ে চলাচল এই বাহনটি।
জানতে চাইলে খিলগাঁও রেলগেটে কর্তব্যরত এক পুলিশ কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) ভোরের আকাশকে বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশা মহানগরীর প্রধান সড়কে চলাচল করা পুরোপুরি নিষিদ্ধ। প্রধান সড়কে এসব যান চলাচল করে না।
তারা অলিগলিতে চলাচল করে। তবে কোথাও প্রধান সড়কেও চললে চালক ও মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মাঝে মাঝে গাড়িগুলোকে ডাম্পিংও করা হয়। তবে প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক লোকের ক্ষেত্রে মানবতার কারণে তাদের বুঝিয়ে ছেড়ে দিই।’
খিলগাঁও এলাকার কয়েকজন অটোরিকশা চলাকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই এলাকায় অলিগলিতে অনেক অটোরিকশা গ্যারেজ রয়েছে। সেখান থেকে দিনচুক্তি ভাড়া দেন মালিকরা। কোনো কোনো রিকশা দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া জমা দিয়ে থাকে।
ওইসব রিকশা আগে গলির মধ্যে চলাচল করত। কিন্তু করোনা মহামারির সময় থেকে ব্যাটারিচালিত এই অটোরিকশা অলিগলি থেকে বের হয়ে প্রধান সড়কেও চলাচল শুরু করেছে। এক্ষেত্রে পুলিশকে ম্যানেজ করে গাড়ি চালানোর কথা জানান তারা।
সিপাহীবাগের হারুন ৪০ বছর ধরে রিকশা চালান। বয়স হয়ে যাওয়ায় প্যাডেল রিকশা ছেড়ে অটোরিকশা চালাচ্ছেন। দিনচুক্তিতে রিকশা ভাড়া নেন তিনি। ভাড়া বাবদ মহাজনকে দৈনিক ৪০০ টাকা দিতে হয়। জমার পর যা থাকে তাই আয়। তা দিয়েই স্ত্রী, তিন মেয়ে এবং এক ছেলেকে নিয়ে কোনোমতে পরিবার চালান।
তিনি ভোরের আকাশকে বলেন ‘এটা আমাদের কর্ম। এটা করে আমাদের খেতে হয়। আমার মতন অনেক অটোরিকশা চালক আছে যারা রিকশা চালিয়ে খাবার খায়। আপনারা যদি এগুলো বন্ধ করে দেন তাহলে আমরা কীভাবে খাব। কীভাবে চলব। কর্ম না করতে পারলে তো মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করে খেতে হবে। আর প্যাডেল রিকশা চালানোর মতো শক্তিও আমার নেই।’
অটো রিকশায় দুর্ঘটনার শিকার বাসাবো বালুর মাঠ এলাকার বাসিন্দা সোলাইমান হক ভোরের আকাশকে জানান, মাসখানেক আগে রাজারবাগের একটি হাসপাতাল থেকে স্ত্রী-সন্তানসহ বাসায় যাচ্ছিলেন অটোরিকশায় চড়ে।
সে সময় রিকশাটি আমতলা মসজিদের সামনে দুর্ঘটনায় পরে। এতে তার স্ত্রী এবং কোলে থাকা মেয়ে আহত হন। তিনি বলেন, ‘রিকশাটি চলানোর সময় অস্বাভাবিক গতির কারণে চালক ব্যালেন্স রাখতে পারেননি। অনেক দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। শুধু তাই নয়, ওইসব রিকশার চালকরাও অভিজ্ঞ নয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র রেজাউল করিম ব্যাটারিচালিত রিকশায় করে নন্দিপাড়া থেকে রেলগেট এসেছেন। যাতায়তের জন্য কেন এই অবৈধ এবং ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাটারিচালিত রিকশা ব্যবহার করলেন এ সম্পর্কে তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা গরিব মানুষসহ অনেক বেকার যুবককে স্বাবলম্বী করেছে।
তা ছাড়া গতির কারণে সময় ও রিকশা ভাড়া কমেছে। অটোরিকশায় যে ভাড়া ১০ টাকা প্যাডেলচালিত রিকশায় তা ২০ বা ৩০ টাকা। তা ছাড়া এই গরিব মানুষগুলো চড়া সুদে কিস্তি নিয়ে রিকশা কিনেছে, বন্ধ করে দিলে তাদের পথে বসতে হবে।
জানতে চাইলে নৌ সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, এসব অযান্ত্রিক বা অবৈধ যানবাহন বন্ধ না করলে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। নানা অজুুহাতে ব্যাটারিচালিত রিকশা এখন অলিগলি ছাপিয়ে রাজপথে দাবড়ে বেড়াচ্ছে।
এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘পঙ্গুত্বের অসহায়ত্ব ঘোচাতে যারা এসব যানবাহন চালাচ্ছেন তাদের সরকারিভাবে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
মন্তব্য