রাজধানীর বনানীতে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক শেখ সোয়েব সাজ্জাদ (৪৪)-এর রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় তার স্ত্রী সাবরিনা শারমিনের (৩০) প্রেমিক কাজী ফাহাদকে (২৭) গ্রেফতার করেছে ক্যান্টনমেনন্ট থানা পুলিশ। শনিবার (৭ মে) তাকে রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ক্যান্টনমেন্ট থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শ্যামল আহমেদ।
গত ৩০ এপ্রিল বনানীর ডিওএইচএস মসজিদ রোডের ১০৫ নম্বর বাসা থেকে মার্কিন নাগরিক শেখ শোয়েব সাজ্জাদের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
তার স্বজনদের অভিযোগ, শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার ও স্ত্রী সাবরিনার দেওয়া মানসিক নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। সাজ্জাদের মৃত্যুর পর থানা পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করে।
একপর্যায়ে ১ মে এ ঘটনায় ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করা হয়। মামলায় সাজ্জাদের স্ত্রী সাবরিনা শারমিন (৩০) এবং স্ত্রীর প্রেমিক কাজী ফাহাদকে (২৭) আসামি করা হয়।
তবে মামলা হলেও পুলিশের তেমন কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি চোখে পড়েনি। গত ৫ মে মার্কিন দূতাবাসে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জানানো হয় পুরো বিষয়টি। ওই রাতেই ২ নম্বর আসামি কাজী ফাহাদকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৭ সালে সাবরিনা শারমিনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক শেখ সোয়েব সাজ্জাদের বিয়ে হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে তারা বসবাস করছিলেন।
২০১৮ সালের মে মাসে সাজ্জাদকে রেখে সাবরিনা বাংলাদেশে চলে আসেন। এরপর রাজধানীর ওয়ারীর ১৯/১ ওয়ারস্ট্রীট রোডের বাসার পঞ্চম তলায় ভাড়া থাকেন। পাশের বাসার কাজী ফাহাদ নামে এক ছেলের সঙ্গে সাবরিনার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
প্রেমিক ফাহাদ সব সময় সাবরিনার বাসায় যাতায়াত করতেন। এ নিয়ে সাজ্জাদের সঙ্গে সাবরিনার ফোনে কথা কাটাকাটি হয় এবং মনোমালিন্য হয়।
একই বাসার নিচতলায় সাজ্জাদের ভাই, বাবা ও মা থাকতেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে সাবরিনার যোগাযোগ ছিল না। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করতেন না সাবরিনা।
গত ১৬ মার্চ সাজ্জাদ ঢাকায় আসেন। এরপর সাবরিনাকে সঙ্গে নিয়ে বনানী ডিওএইচএস মসজিদ রোডের ১০৫ নম্বর বাসার তৃতীয় তলায় শ্বশুরবাড়িতে ওঠেন। সেখানে ওঠার পরপরই সাজ্জাদের ওপর অত্যাচার বাড়তে থাকে।
তিনি দেশে আসার পরপরই তার মার্কিন পাসপোর্ট (৫৭৫৫৪৪৬৮১) ও আইফোন-১১ কৌশলে নিয়ে নেন সাবরিনা। পাসপোর্ট ও আইফোন ফেরত চাইলেও তা না দিয়ে বরং ১৫ এপ্রিল সাজ্জাদকে বাবার বাসায় রেখে অন্যত্র চলে যান সাবরিনা।
সাজ্জাদ যেন বাসা থেকে বের হতে না পারেন সে জন্য গার্মেন্টস ব্যবসায়ী শ্বশুর শাখাওয়াত হোসেন সব সময় সাজ্জাদকে নজরদারিতে রাখতেন। স্ত্রীর প্রেমিক কাজী ফাহাদও সাজ্জাদকে হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন।
বেশি বাড়াবাড়ি করলে পরিবারের বিশাল ক্ষতি করারও হুমকি দেওয়া হয়। এমনকি মার্কিন দূতাবাসে জানালেও বড় ক্ষতি হবে বলে শাসানো হয়। শেষ পর্যন্ত সাজ্জাদ শুধু পাসপোর্ট আর আইফোন ফেরত চেয়েও পাননি।
একপর্যায়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে সাজ্জাদ শ্বশুরবাড়িতে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার বিষয়টি শ্বশুরবাড়ি মারফত জানতে পারেন সাজ্জাদের বড় ভাই শেখ সোহেল সায়াদ আহমেদ।নিহত সাজ্জাদের বড় ভাই শেখ সোহেল সায়াদ আহমেদ অভিযোগে জানান, শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার পর সাজ্জাদের পাসপোর্ট কেড়ে নিয়েছিল স্ত্রী সাবরিনা।
তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন-টাকা রেখে দেওয়া হয়। পাসপোর্ট ও টাকা-পয়সা হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন সাজ্জাদ। বার বার পাসপোর্ট ও মোবাইল ফেরত চেয়েও পাননি।
তিনি বলেন, আমার ছোট ভাই স্ত্রীর পরকীয়া সংক্রান্ত মানসিক অত্যাচার মেনে নিতে পারেননি। তার ওপর পাসপোর্ট ও আইফোন ফেরত পাননি। এমনকি তার মানিব্যাগও ছিনিয়ে নেওয়া হয়। মানিব্যাগে অনেকগুলো ডলার ছিল।সোহেল সায়াদ আহমেদ বলেন, সাজ্জাদকে ঘরবন্দী রাখা হয়েছিল যেন কোথাও গিয়ে বিচার চাইতে না পারেন। এভাবেই তাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
আমাদের ক্ষতি হবে ভেবে সাজ্জাদ কাউকে কিছু বলতে দিতো না। আমরা সাবরিনা ও ফাহাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
সাজ্জাদকে তার স্ত্রী সাবরিনা যে অত্যাচার করত তার প্রমাণ বেশ কয়েকটি কথোপকথনের স্ক্রিন শর্ট সাংবাদিকদের হাতে এসেছে। সেই কথোপকথন থেকে জানা যায়, সাবরিনা সব সময় টাকা দাবি করেন সাজ্জাদের কাছে।
এমনকি কেমনে টাকা আদায় করতে হয় তা জানা আছে বলে হুমকি দেয় সাজ্জাদকে। ‘ঢাকায় তোর ফ্ল্যাট দখল করে নেব, কে বাঁচাতে আসে তাই দেখব। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ বলে হুমকি দেয় সাবরিনা।মার্কিন নাগরিক সাজ্জাদের মৃত্যুর পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশ্বজিৎ সাহা নামে একজন ফেসবুকে পোস্ট করে বলেন, ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালার এ কেমন চলে যাওয়া! অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, নিউ ইয়র্কের অতি পরিচিত মুখ শেখ সোয়েব সাজ্জাদ গত ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশের বনানীতে তার শ্বশুরবাড়িতে আত্মহত্যা করেন।
গত ১৬ মার্চ সাজ্জাদ ঢাকায় যান। এরপর থেকে ওর মোবাইল ফেসবুক থেকে শুরু করে সবকিছুই দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। সাজ্জাদ অনেক স্বপ্ন দেখতেন। স্বপ্ন দেখাতেন মানুষকে। আমাজনে অনেককে চাকরি দিয়েছিলেন।
কোভিডের সময় বিভিন্ন পরিবারে আমরা সিটি থেকে একসঙ্গে খাবার পাঠিয়েছি। সে সময় প্রায়ই মুক্তধারায় আসতেন। কত গল্প করতাম আমরা। সেই সাজ্জাদই এভাবে চলে যাবেন, কখনোই ভাবিনি।
সাজ্জাদের ভাইয়ের অভিযোগ, সাজ্জাদের মৃত্যুর পর থানা পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করে। একপর্যায়ে ১ মে মামলা রুজ্জু হলেও তেমন কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি চোখে পড়েনি।
পরে গত ৫ মে মার্কিন দূতাবাসে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে পুরো বিষয়টি জানানো হয়। ওই রাতেই ২ নম্বর আসামি কাজী ফাহাদকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ক্যান্টনমেন্ট থানার এসআই শ্যামল আহমেদ গতকাল শনিবার বলেন, এ ঘটনায় বেশি কিছু বলতে পারব না।
মামলার ২ নম্বর আসামি ফাহাদ গ্রেফতার আছে। আমরা রিমান্ডের জন্য আদালতে অনুমতি চেয়েছি। রিমান্ডে পেলে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এসআই শ্যামল আহমেদ আরো বলেন, সাজ্জাদের মৃত্যুর বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। এখনো ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।
মন্তব্য