-->
শিরোনাম

২৫০ টাকার জন্য ৮ ঘণ্টার মৃত্যুঝুঁকি!

ইফ্ফাত শরীফ
২৫০ টাকার জন্য ৮ ঘণ্টার মৃত্যুঝুঁকি!
এভাবেই ঝুঁকি নিয়ে লেগুনায় কাজ করছে শিশুরা

‘রেলগেট, বাসাবো সিট খালি আছে। আগে গেলে আগে আসেন। আর দুইজন লাগে দুইজন’, বাসাবো টেম্পোস্ট্যান্ডে লেগুনার দরজায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ঝুলে গলা ফাটিয়ে এভাবেই যাত্রী ডাকছিল (ছদ্মনাম) শিশু আবির।

বয়স সর্বোচ্চ ১১ বছর। লেগুনার পেছনে এক হাতে বাম্পার ধরে দাঁড়িয়ে ঝুলে ঝুলে অন্য হাতে দিয়ে লোক ডাকছিল।

পেছনে দাঁড়িয়েই আবার যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়াও আদায় করছে। রাজধানীর বাসাবো থেকে গুলিস্তান রুটে চলা লেগুনার কন্ডাক্টর আবির।

ছোট এ শিশুটির এ বয়সে থাকার কথা ছিল স্কুলে বা খেলার মাঠে। কিন্তু পেটের দায়ে তাকে নামতে হয়েছে জীবিকার জন্য।

ভোরের আকাশের সঙ্গে কথা হলে সে জানায়, তার মা নন্দিপাড়ায় একটি গার্মেন্টে কাজ করে। বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। তার একটি বড় বোন আছে।

যদিও বিয়ে হয়ে এখন স্বামীর সঙ্গে থাকে। ছোট্ট শিশু আবিরের এখন একমাত্র সঙ্গী মা। মাকে নিয়ে রাজধানীর নন্দিপাড়ার ছোট বটতলা এলাকার ভাড়া বাসা তাদের।

সে আরো জানায়, গাড়িতে যাত্রী উঠাতে সারা দিন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে মানুষকে ডাকতে হয়। দুদিন কাজ করি আর এক দিন বাসায় বিশ্রাম করি।

আবির যেদিন বিশ্রাম করে সেদিন এলাকায় বাজারে সবজির দোকানগুলোয় সহযোগীর কাজ করে। মাঝেমধ্যে ক্রেতাদের বাজারের ব্যাগ বহন করে কিছু বাড়তি আয় করে থাকে।এসব কাজ করতে তার কষ্ট হয় কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে আবির জানায়, ‘কষ্ট হলেও কিছু করার নাই। কাজ না করলে ভাত দিবে কে।

আম্মার অনেক কষ্ট হয়ে যায় সংসার চালাতে, তাই আমি টুকটাক কাজ করি। ক্লাস ওয়ান পর্যন্ত পড়ছি, এখন স্কুলে যেতে আর ভালো লাগে না।’

লেগুনার কন্ডাক্টর হিসেবে কত টাকা পায় আবির? এ প্রশ্নের জবাবে সে জানায়, নিয়মিত কাজ করলে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা পাওয়া যায়।

কিন্তু করোনার পর থেকে আয় কম হওয়ার কারণে চালকরা আর হেলপার রাখতে চান না। তাছাড়া মালিকরা জমা বাড়িয়ে দেওয়ায় প্রতিদিন হেলপারের ব্যয় মেটানো চালকদের পক্ষে কষ্টসাধ্য।

এখন চালকরা যাত্রীদের দিয়ে ভাড়া তোলার রেওয়াজ শুরু করেছে। সে জানায়, প্রতিদিন কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়।

কিন্তু আমার শরীর এত পরিশ্রম সহ্য করতে পারে না। ৬ ঘণ্টা কাজ শেষে ছুটি চাইলে চালক গালাগালি করে। আরেক দিন আসলে রাখতে চায় না।

অথচ আইন অনুযায়ী, দেশে তো শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম রোধে আইন আরো কঠোর। কিন্তু এসবের প্রতি তেমন কোনো নজির নেই।

আবিরের মতো শিশুরা এ শহরে দিনভর প্রকাশ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিজেদের নিয়োজিত রাখলেও দেখার যেন কেউ নেই।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশনের মহাসচিব জেডএম কামরুল আনাম বলেছেন, শিশু শ্রমিক আছে এমন যতগুলো সেক্টর আছে, প্রতিটি সেক্টরের শিশুরের পুনর্বাসনের প্রয়োজন আছে।

সরকারের যে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) বাস্তবায়ন করতে হলে শিশুশ্রম বন্ধ করা অতি জরুরি। তা না হলে এসব শিশুর সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে।

এর ফলে তারা এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভুগবে। তিনি বলেন, শিশুশ্রম বন্ধ করতে শুধু সরকারের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়, সামাজিক আন্দোলনও জরুরি।

যারা শিশুসন্তানদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পাঠায়, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ভোরের আকাশকে জানান, রাজধানীতে বিভিন্ন যানবাহন চলছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে।

এগুলো নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার সদস্যরা দেখেও না দেখার ভান করেন। যাত্রীরাও কিছু বলে না। অথচ এটা চরম অপরাধ। চোখের সামনে এসব শিশুর শৈশব শেষ হয়ে যাচ্ছে।

আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি, শিশু শ্রমিকদের পুনর্বাসন করা হয়েছে। শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিতদের গ্রেপ্তার বা শাস্তি দেওয়া হয়েছে এমন খবরও শোনা যায় না।

তিনি বলেন, রাজধানীতে প্রকাশ্যে শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে বা গাড়ি চালাচ্ছে! কিন্তু কেউ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শ্রম নিয়োগ সম্পর্কে যে মান নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, সেখানে মূলত চারটি মাত্রার কথা বলে হয়েছে, সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা, যৌথ দরকষাকষির অধিকার, শিশু শ্রমিকের অনস্তিত্ব ও বৈষম্যহীন নিয়োগ ব্যবস্থা।

শিশু শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিধিনিষেধের প্রশ্নটি জড়িয়ে দেওয়া উচিত হলেও সে নিশ্চয়তা নেই।

দেশে শিশুশ্রম বন্ধে ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে (১৯৮৯) স্বাক্ষরকারী ও অনুসমর্থনকারী প্রথম রাষ্ট্রগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ।

১৯৯৪ সালে জাতীয় শিশুনীতি প্রণয়ন করা হয় বটে, কিন্তু আদৌ কি সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে প্রয়োজন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বিত উদ্যোগ আর সমাজের সর্বস্তরে সচেতনতা।

অন্যদিকে দেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধের সময়সীমা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ ২০২১ সালের মধ্যে দেশ ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমমুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ হলেও তা সম্ভব হয়নি।

এ নিয়ে কয়েক দফা সময় পেছাল সরকার। সম্প্রতি নতুন করে ২০২৫ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

সরকারি হিসাব মতে, দেশে ৩৪ লাখ শিশুশ্রমে এবং ১২ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিযুক্ত।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে সবরকম শিশুশ্রম বন্ধের তাগিদ আছে।

মন্তব্য

Beta version