ঢাকা: ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পরিবহনে চাঁদাবাজির কথা সবার জানা। কিন্তু রাইড শেয়ারিং যানবাহন যে নীরবে চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে, তা অনেকেরই অজানা। বলা যায় এটা এই শহরে একদমই নতুন আইডিয়া। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে যাত্রী তুলতে রাইড শেয়ারিং চালকদেরও মোটরসাইকেল প্রতি গুনতে হয় ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। ঢাকা শহরে এরকম চাঁদাবাজির পয়েন্ট আছে কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০টির মত। এসব অফলাইনে রাইড শেয়ারিং এবং চাঁদা তোলার বিষয়ে ভোরের আকাশের পক্ষ থেকে অনুসন্ধানে বিষয়টি সামনে এসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই পয়েন্টগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন এবং স্থানীয় ক্ষমতাশালীরা প্রভাব খাটিয়ে রাইডারদের কাছ থেকে চাঁদা উঠাচ্ছে। এই চাঁদাবাজরা এমন একটি জায়গা বেছে নেয়, যেখানে যাত্রী সমাগম থাকে অনেক। এসব পয়েন্টের দায়িত্বে থাকে কিছু লাইনম্যান। স্ট্যান্ড থেকে যখনই কোনো রাইডার অফলাইনে যাত্রী ওঠায় তখন লাইনম্যান ১০ টাকা এমনকি কোনো কোনো সময় ৩০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়।
এদিকে যারা চাঁদা নিচ্ছে তারা বলছে, বাইকারদের স্ট্যান্ডে বসার সুযোগসহ সে স্থানের পুলিশের মামলা বা হয়রানি থেকে তাদের সেফটি দেয়া হয়। মোটরসাইকেল রাইডারদের অভিযোগের ভিত্তিতে এবং বেশ কিছু স্থান সরেজমিনে ঘুরে এই চাঁদাবাজির সত্যতা মিলে। চাঁদাবাজির বিষয়ে অনেক রাইডারের কোনো আপত্তি না থাকলেও বেশিরভাগ রাইডার এটাকে জুলুম এবং অনৈতিক বলে মনে করছেন।
এসব পয়েন্টের মধ্যে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচে বাসস্ট্যান্ডে ১০ টাকা করে, ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টারে ২০ টাকা করে, মোহাম্মদপুর বিআরটিসি স্ট্যান্ডে ১০ টাকা, বসিলা স্ট্যান্ড থেকে ১০-২০ টাকা, খিলক্ষেত স্ট্যান্ড থেকে ১০ টাকা, এয়ারপোর্ট স্ট্যান্ড থেকে ১০ টাকা, সদরঘাট স্ট্যান্ড থেকে ১০ টাকা এবং ঘাটের ভেতর স্পেশাল জায়গায় ২০ টাকা (স্থায়ী বাইকারদের এখানে কার্ডেরও ব্যবস্থা করা আছে), শাঁখারী বাজার ১০ টাকা, মুগদা পাম্পের পাশের স্ট্যান্ড ১০ টাকা, মিরপুর সাড়ে এগারোতে ১০ টাকা করে মোটরসাইকেল থেকে চাঁদা নেয়া হয়। একই ধরনের চাঁদা তোলা হয় অন্যান্য স্থানে।
অন্যদিকে শুধু প্রধান বাসস্ট্যান্ডগুলো এবং শহরের মেইন পয়েন্টগুলোতে যেমন পল্টন, মতিঝিল, ধানমন্ডি, খিলগাঁও রেলগেটের মতো এলাকায় চাঁদা ওঠানো হয় না। তবে এসব জায়গায় অবৈধভাবে বাইক স্ট্যান্ড গড়ে তোলা হয়েছে। যার ফলে রাস্তায় একপ্রকার বাড়তি প্রেসারের কারণে জ্যামের সৃষ্টি হয়।
জানা গেছে, চাঁদা নেয়া হয় এমন প্রতিটি স্ট্যান্ডে দৈনিক গড়ে পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠানো হয়। সে হিসাবে ঢাকা শহরে যতগুলো পয়েন্ট আছে তা থেকে দৈনিক আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা চাঁদা ওঠানো হয়। মাসে প্রায় এক কোট টাকার মতো চাঁদা ওঠানো হয় এ সব অবৈধ স্ট্যান্ড থেকে।
বিআরটিএর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় বর্তমানে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৫ লাখ ৮৪ হাজার ৪৯০টি। এর মধ্যে ঢাকা শহরে দৈনিক রাইড শেয়ারিং হয় প্রায় ৩ লাখের মতো। এর মধ্যে বেশিরভাগ রাইড শেয়ারিং হয়ে থাকে অফলাইনে। যার ফলে এসব অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং এক প্রকার মুখ থুবড়ে পড়েছে। এমনকি সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে এই অফলাইনে রাইডের ফলে।
এদিকে অফলাইনে রাইড শেয়ারিং বর্তমানে একটা প্রচলিত নিয়ম হয়ে উঠেছে রাইডার এবং গ্রাহক উভয়ের মাঝে। ফলে রাইড শেয়ারিং করা ব্যক্তি এবং রাইডার (গ্রাহক) উভয়েরই নিরাপত্তা নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। অফ লাইনে রাইড শেয়ারিং বন্ধের বিষয়ে তেমন কোনো কিছু করার নেই বলে জানিয়েছে রাইডশেয়ারিং কোম্পানিগুলো। অফলাইনে রাইড শেয়ারিং বন্ধের বিষয়ে সামান্য কিছু জরিমানা ছাড়া তেমন কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি সরকারের বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে। বিষয়টি জানার জন্য একাধিক রাইডশেয়ারিং কোম্পানিতে যোগাযোগ করা হলেও কারও সাড়া পাওয়া যায়নি। পাঠাও কোম্পানির সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হোসেন ইলিয়াসের মুঠোফোনে কিছু প্রশ্ন পাঠালে তার উত্তর দেননি। উল্টো সংবাদকর্মী জেনে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটি ব্লক করে দেন তিনি।
এদিকে, যারা অফলাইনে রাইড শেয়ার করে তাদের ভাষ্য কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত কমিশন হার এবং অনেক সময় পিকআপ লোকেশন দূরে হওয়ার কারণে তারা অ্যাপের মাধ্যমে রাইড শেয়ার করতে অনীহা প্রকাশ করে। অফলাইনে রাইড শেয়ারিংয়ের জন্য এখন এলাকাভিত্তিক স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। এসব স্ট্যান্ড থেকে যাত্রী ওঠানো-নামানো বাবদ ১০-৩০ টাকা দিতে হচ্ছে বিভিন্ন স্ট্যান্ডে থাকা লাইনম্যানকে। এসব স্ট্যান্ডের দায়িত্বে থাকা লোকদের ভাষ্য, তারা সিটি করপোরেশন থেকে ইজারা নিয়েছে তাই কোনো কোনো স্ট্যান্ড বাইকপ্রতি ২০ টাকা কেউ আবার ৩০ টাকা নিচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, যাত্রাবাড়ীর বাইক ও সিএনজি স্ট্যান্ডের চাঁদা আদায় করেন স্থানীয় কিছু লাইনম্যান। তারা এই টাকা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মিরাজ হোসেনের নির্দেশে তোলেন। স্থানীয় সিএনজি এবং বাইক ড্রাইভারদের জিজ্ঞেস করলে তারা জানান, যাত্রাবাড়ী স্ট্যান্ডের সবকিছুর দায়িত্ব এই আওয়ামী লীগ নেতা মিরাজের কাছে। তিনি যাত্রাবাড়ী থানা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা, পাশাপাশি ১৪ দলের সমন্বয়ক হারুনুর রশীদ মুন্নার খাস অনুসারী বলে জানা গেছে।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিনে মিরাজ হোসেনকে পাওয়া যায়নি। পরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লাইনম্যানের কাছ থেকে মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করে মিরাজের সঙ্গে যোগাযোগ করে মোটরসাইকেল থেকে চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমার সিটি করপোরেশন থেকে সিএনজি স্ট্যান্ডের জন্য ইজারা নেয়া আছে। তবে মোটরসাইকেল থেকে নেয়ার অনুমতি নেই। দৈনিক সিএনজি এবং বাইক স্ট্যান্ড থেকে ৫-৬ হাজার টাকার মতো ওঠে। যার মধ্যে শুধু বাইক স্ট্যান্ড থেকে উঠে তিন থেকে চার হাজার টাকা।
অবৈধভাবে মোটরসাইকেল থেকে ১০ টাকা করে নেয়াকে যাত্রাবাড়ীর এই আওয়ামী লীগ নেতা মিরাজ সমাজসেবা হিসেবে দেখছেন। মিরাজ বলেন, আমি কারো থেকে জোর করে কোনো টাকা আদায় করি না। এই ১০ টাকা করে ওঠানো কোনো চাঁদাবাজি না। আজকাল ১০ টাকা কোনো কিছুই না মানুষের কাছে। আমার যেসব লাইনম্যান আছে তাদের সংসার চলে এই টাকায়। এটাকে চাঁদাবাজি না বলে ভিক্ষার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। অবশ্য অবৈধভাবে চাঁদাবাজির জন্য কিছুদিন আগে মিরাজের তিন লাইনম্যান র্যাবের হাতে আটক হয়। আটককৃতরা হচ্ছে সজীব, পারভেজ এবং মনির। তবে এদের মধ্যে পারভেজ ও মনির ছাড়া পেলেও সজীব এখনো ছাড়া পায়নি। সে জেলখানায় আছে।
মোটরসাইকেল স্ট্যান্ড থেকে চাঁদা ওঠানোর বিষয়ে যাত্রাবাড়ী ট্রাফিক অফিসার ইনচার্জ মেনন বলেন, আমাদের সামনে কোনো অনৈতিক কাজ ধরা পড়লে আমরা তার বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেই। তবে আমাদের চোখের আড়ালে বা গোপনে কেউ যদি কিছু করে তাহলে কিছু করার নেই। আমি যাত্রাবাড়ীর ট্রাফিকের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে এখানের অবৈধ স্ট্যান্ডগুলোকে বন্ধ করে দিয়েছি। আগে যেখানে লেগুনা স্ট্যান্ড চার রাস্তার মোড়ে ছিল, তা সরিয়ে ভেতরে নিয়ে গেছি। এই অবৈধ স্ট্যান্ডগুলো থেকে প্রায়ই কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তাকে দৈনিক এবং সাপ্তাহিক ভিত্তিতে মাসোহারা নিতে দেখা গেছে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিনে এক পুলিশ কর্মকর্তা স্থানীয় এক লাইনম্যান থেকে তার দৈনিক মাসোহারা নিতে গিয়েছিল। একপর্যায়ে তাকে কেন টাকা চাইছেন জানতে চাইলে সেই ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা স্থান থেকে পালিয়ে যান।
এ ব্যপারে যাত্রাবাড়ী ট্রাফিক অফিসার ইনচার্জকে জিজ্ঞাস করলে তিনি বলেন, আমাদের ডিউটিরত কোনো কর্মকর্তা যদি এ কাজে জড়িত থাকে, তাহলে শাস্তির আওতায় আনা হবে বলে আশ্বস্ত করেন এই ট্রাফিক অফিসার ইনচার্জ মেনন।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য