ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা, বিদেশ গমনসহ বিভিন্ন কারণে প্রতিদিন প্রায় ২৫ লাখ মানুষ রাজধানীতে আসে। বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সৃষ্ট উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে পরিবহন চলাচল একেবারেই কমে গেছে। ফলে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও যানবাহন না পেয়ে হেঁটেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরীর মধ্যে যান চলাচল যেমন একেবারেই কমেছে, আবার যাত্রীর অভাবে দূরপাল্লার কোনো বাস ঠিকমতো ঢাকায় আসতে পারছে না। সমাবেশ ঘিরে রাজধানী ঢাকার প্রতিটি প্রবেশপথে সতর্ক প্রহরায় রয়েছে পুলিশ। প্রতিটি যা বাহন এমনকি ব্যক্তিগত পরিবহনও তল্লাশির মুখে পড়ছে। দূরপাল্লার বাসগুলোকে চেক করে তবেই ঢাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া পুলিশের তল্লাশির মুখে পড়তে হচ্ছে পথচারীসহ সাধারণ যাত্রীদের। তল্লাশির সময় কাউকে সন্দেহ হলে আটকও করা হচ্ছে।
আজ শনিবার ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। অবশেষে নানা নাটকীয়তা শেষে গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করার অনুমতি পেয়েছে বিএনপি। প্রথমে বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হলেও বিএনপি সেখানে সমাবেশ করতে রাজি হয়নি। পল্টনের সমাবেশে অনড় থাকার কারণে আগ থেকে সেখানে দলের নেতাকর্মীরা জড়ো হতে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পল্টন এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
সমাবেশ ঘিরে এই উত্তেজনা সাধারণ মানুষের মনে এক ধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছে। ফলে তারা বেশি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়ায় রাস্তায় মানুষের চলাচল কমেছে।
এদিকে ঢাকার প্রতিটি প্রবেশমুখ এবং রাজধানীর ভেতরের চলাচলকারী পরিবহনগুলোও তল্লাশির মুখে পড়ছে। তল্লাশির সময় কাউকে সন্দেহ হলে আটক করা হচ্ছে। এ কারণে অন্যান্য সময়ের তুলনায় মহাসড়কে দূরপাল্লার বাসের সংখ্যা তুলনামূলক কম। এ ছাড়া যাত্রীসংখ্যা অন্যান্য সময়ের তুলনায় কম।
সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর অন্যতম প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ীর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড, মৌচাক, মদনপুর, মেঘনা টোলপ্লাজার সামনে মোট চারটি পুলিশ চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। গাবতলী ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে রাজধানীর বাইরে থেকে আসা পরিবহনগুলোতে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ।
বুধবারের সংঘাতের পর বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে ঢাকার সড়কে যানবাহন চলাচল কমে গেছে। ঢাকা থেকে দূরপাল্লার বাসও কম ছেড়ে যাচ্ছে। শুক্রবার ছুটির দিনে কাক্সিক্ষত বাসের দেখা মেলেনি। বাস পেতে যাত্রীদের বেশ অপেক্ষা করতে হচ্ছে। সন্ধ্যার পর মানুষের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। যেসব স্থানে বাসের অপেক্ষায় মানুষের ভিড় দেখা যায়, সেসব স্থানে মানুষও কম দেখা গেছে। গাবতলীতে তল্লাশি কার্যক্রম চালাচ্ছেন দারুসসালাম থানার পুলিশের সদস্যরা।
তল্লাশির বিষয়ে একজন এসআই বলেন, নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই এই তল্লাশি চালানো হচ্ছে। বিজয় দিবস ও রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মসূচিকে ঘিরে যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা কিংবা নাশকতা না হয়। ব্যাগে সন্দেহজনক কিছু আছে মনে হলে সেগুলো খুলে দেখা হচ্ছে।
রাজধানী ঢাকার অন্যতম প্রবেশপথ ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ও মানিকগঞ্জ-হেমায়েতপুর আঞ্চলিক মহাসড়কে যান চলাচল কমে গেছে। শুক্রবার সকাল থেকেই দুই সড়কে গণপরিবহনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত যান চলাচলের সংখ্যা অন্যদিনের তুলনায় কম। গাবতলী এলাকায় দেখা যায়, গাবতলী-আমিনবাজার সেতুর মুখে গাবতলী অংশে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ।
কুষ্টিয়া, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, রাজবাড়ী, পাবনাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা দূরপাল্লার প্রতিটি বাস থামিয়ে ভেতরে গিয়ে যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কাউকে সন্দেহভাজন মনে হলে ওই যাত্রীর সঙ্গে থাকা ব্যাগ কিংবা বস্তা খুলে দেখা হচ্ছে। এদিকে দুই মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চৌকি বসিয়েছে পুলিশ। এসব চৌকিতে পুলিশ বিভিন্ন যানবাহন থামিয়ে যাত্রীদের তল্লাশি করছে। পুলিশের দাবি, কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য নয় বরং জঙ্গি, সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার ও নাশকতা ঠেকাতে ১ ডিসেম্বর থেকে এই বিশেষ অভিযান চলছে।
এদিকে পরিবহন মালিকরা বলছেন, ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশের দিনও ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোয় বাস চলাচল স্বাভাবিক থাকবে। বাস মালিক সমিতির সেই ঘোষণা সমাবেশের আগের দিন থেকেই কার্যকর দেখা যায়নি। শুধু গাবতলী নয় বিমানবন্দর সড়কের বনানী, কাকলী, চেয়ারম্যানবাড়ি, মহাখালী ঘুরে দেখা গেছে, দূরপাল্লার বাস তেমন নেই। বাস টার্মিনালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও বাস পাচ্ছেন যাত্রীরা।
গাজীপুর থেকে সায়েদাবাদগামী বলাকা পরিবহনের হেলপার মঈনুল হক বলেন, পথে যাত্রী কম বলে বাসও কম। ঢাকার বাইরে থেকে দূরপাল্লার কোনো পরিবহন আসছে না। বাসেও যাত্রী কম। বিএনপির জনসভা, তাই পরিবহনের গাড়িও কিছু কম চলছে। আজিমপুর থেকে আবদুল্লাহপুরগামী বিকাশ পরিবহনের একটি বাসের হেলপার আব্দুল মোতালেব বলেন, এই রুটের কিছু গাড়ি বন্ধ রাখা হয়েছে। এর পরেও গাড়ি ভরে না, সিট ফাঁকা যায়।
এদিকে বিএনপির সমাবেশ ঘিরে রাজধানীতে পরিবহন চলাচল স্বাভাবিক রাখার ঘোষণা দেয় পরিবহন মালিক সমিতি। বৃহস্পতিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় শনিবার ঢাকা, শহরতলি এবং আন্তঃজেলা রুটে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যান চলাচল যাতে কোনো প্রকার বাধার মুখে না পড়ে, সেজন্য শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে পরিবহন মালিক সমিতি।
বিএনপির সমাবেশ সামনে রেখে বুধবার থেকেই কড়াকড়ি শুরু হয় দেশের রেল যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু কমলাপুরে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সেখানে শুরু হয়েছে তল্লাশি। যাত্রীদের তল্লাশি করেন ডিবি ও রেলওয়ে থানার পুলিশ। তবে তারা দাবি করছেন শুধু সমাবেশই নয়, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করেই মূলত এ নজরদারি চলছে- এমনটাই জানিয়েছেন রেলওয়ে থানার ওসি ফেরদৌস বিশ্বাস।
তিনি বলেন, পুরো ডিসেম্বর মাসজুড়েই তল্লাশি কার্যক্রম চালু থাকবে। বিজয় দিবস সামনে রেখেই মূলত কোনো প্রকার জঙ্গি হামলা থেকে যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে ডিবি ও রেলওয়ে পুলিশের কয়েকটি দল ঢাকার সব স্টেশনে নজরদারি চালু রাখবে।
সাইনবোর্ড চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করা ডিএমপির ডেমরা জোনের পেট্রল ইন্সপেক্টর নুরুল ইসলাম মল্লিক বলেন, এটি ঢাকার প্রবেশ এবং বের হওয়ার পথ। এখানে নিরাপত্তা দেয়ার কাজটি আমরা করছি। আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছি। যাতে দেশের মানুষ ভালোভাবে থাকতে পারে। এ মহাসড়কে পুলিশের অনেকগুলো চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা সবসময় প্রস্তুত।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য