-->

রাজধানী পানির নিচে

মো. মনির হোসেন
রাজধানী পানির নিচে
  • ৬ ঘণ্টায় ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত
  • কোথাও কোমর পানি, কোথাও হাঁটু পানি
  • পানি ঢুকেছে দোকান ও বাসা-বাড়িতে
  • রাস্তায় গাড়ি বিকল, যানজট
  • দুর্ভোগে নাকাল মানুষ

ঘুম থেকে উঠেই চরম দুর্ভোগের শিকার হলো রাজধানীবাসী। শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত প্রবল বর্ষণ হয়েছে। এ সময় ঢাকায় ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এটা মৌসুমের সব চেয়ে বেশি বৃষ্টি বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

পানিতে ডুবে গেছে উঁচু-নিচু বিভিন্ন সড়ক এবং পাড়া মহল্লার অলি-গলি। সড়কে কোথাও হাঁটু পানি; আবার কোথাও কোমর পর্যন্ত পানি ছিল। ফলে গন্তব্যে পৌঁছাতে ঘরের বাইরে পা দেওয়া মানুষ নাকাল হয়েছেন। রাস্তা উপচে ময়লা পানি ঢুকেছে বাজারে, দোকানে এমনকি অনেক বাসাবাড়িতেও। পানির কারণে সড়কে নষ্ট গেছে অনেক যানবাহন। এতে সৃষ্টি হয় যানজট। এদিন স্কুল, কলেজ ও অফিস-আদালত বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে পড়া মানুষের সংখ্যা কমছিল। কিন্তু চাকরি প্রার্থীরা পড়েন চরম দুর্ভোগে। এদিকে, গন্তব্যে যাওয়ার জন্য সময় নিয়ে বের হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা মেট্রো পলিটন পুলিশ। এই দুর্ভোগের জন্য অপরিকল্পিত উন্নয়নকে দুষছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া খাল ও সবুজ কমে যাওয়াকেও দায়ী করেন তারা। ড্রেনের সর্বোচ্চ ব্যবহারের তাগিদ দিয়েছেন তারা।

সরেজমিন দেখা গেছে, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, কাকরাইল, নয়া পল্টন, পুরানা পল্টন, আরামবাগ, শাহজাহানপুর, ফকিরেরপুল, বিজয়নগর সড়কে পানি উঠেছে। পানিতে তলিয়েছে দয়াগঞ্জ মোড়, সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল, নিমতলী, কমলাপুরের কাছে টয়েনবি সার্কুলার রোড, যাত্রাবাড়ী, কাজলা, শনির আখাড়া, রায়েরবাগ, গোলাপবাগের নিচু এলাকাসহ আরো কয়েক এলাকায়। কাকরাইল, মোহাম্মদপুর, শ্যাওড়াপাড়া, কাজীপাড়াসহ মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা এবং মিরপুরে মাজার রোড, অ্যালিফেন্ট রোড, মৎস্য ভবন, সেন্ট্রাল রোড, ধানমণ্ডির ২৭ নম্বর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেইট, তেজগাঁও, বিজয় সরনী, পশ্চিম তেজতুরী বাজার, তেজকুনি পাড়া, দক্ষিণ মনিপুরের মোল্লাপাড়া, মহাখালীর বিভিন্ন রাস্তায় পানি জমেছে।

শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে মহাখালী দক্ষিণ পাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে কোমর সমান পানি। এই এলাকায় সড়কের পাশে দোকানপাট এবং কোনো কোনো ভবনের নিচতলাতেও পানি ঢুকেছে। সেখানকার ‘মাহবুব জেনারেল স্টোরে’ পানি ঢোকায় এর স্বতাধিকারী মাহবুবুল আলমের কথায় ক্ষোভ ঝরেছে।

তিনি বলেন, আমার দোকান রাস্তার ধারে। কিছুদিন আগে আমি দোকানের সামনে কিছুটা পাকা করে দিয়েছিলাম। তাতে কোনো লাভ হয়নি। বৃষ্টির পানি প্রায় কোমরসমান হয়ে দোকানে ঢুকেছে। মালামাল সব ভিজে বৃষ্টিতে ক্ষতি হয়ে গেল আমার। এত উন্নয়নের কথা বলা হয়, অথচ সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তায় পানি জমে বাসাবাড়িতে ঢুকে যায়। দুর্ভোগের সীমা থাকে না।

তেজগাঁও থেকে মহাখালীতে রিকশায় করে আসা সবুজ হোসেন বলেন, রিকশায় উঠেও নিস্তার নেই, ভিজে যাচ্ছি, এত পানি। কাজে বের হয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে ভুলই করলাম। সকালে পানিতে ভিজে দোকানে যাচ্ছিলেন নাখালপাড়ার বাসিন্দা সফুরা বেগম। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, সকালে বাচ্চাগুলো কিছুই খায়নি। বাধ্য হয়েই বের হলাম। কয়দিন আগেই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করল। কিন্তু, লাভ হয়নি কোনো। প্রায় কোমরসমান পানি। এই জ্বালার কোনো সমাধানই নেই।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় আছে এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি থেকে প্রবল অবস্থায় রয়েছে। যার কারণে ভারী থেকে অতিভারি বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানা বলেন, শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ঢাকায় ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আজ শনিবার বিকাল পর্যন্ত পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের প্রবণতা অব্যাহত থাকবে। এরপর থেকে বৃষ্টি কমবে। সকাল থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টির কারণে কাকরাইল, মোহাম্মদপুর, শ্যাওড়াপাড়া, কাজীপাড়াসহ মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা এবং মিরপুরে মাজার রোড, অ্যালিফেন্ট রোড, মৎস্য ভবন, সেন্ট্রাল রোড, ধানমণ্ডির ২৭ নম্বর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেইট, তেজগাঁও, বিজয় সরনী, পশ্চিম তেজতুরী বাজার, তেজকুনি পাড়া, দক্ষিণ মনিপুরের মোল্লাপাড়া, মহাখালীর বিভিন্ন রাস্তায় পানি জমেছে। এছাড়া শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, কাকরাইল, নয়া পল্টন, পুরানা পল্টন, আরামবাগ, শাহজাহানপুর, ফকিরেরপুল, বিজয়নগর সড়কে পানি উঠেছে। পানিতে তলিয়েছে দয়াগঞ্জ মোড়, সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল, নিমতলী, কমলাপুরের কাছে টয়েনবি সার্কুলার রোড, যাত্রাবাড়ী, কাজলা, শনির আখাড়া, রায়েরবাগ, গোলাপবাগের নিচু এলাকাসহ আরো কয়েক এলাকায়।

জলাবদ্ধতার কারণে বিভিন্ন রাস্তায় গাড়ি বিকল হয়ে যানজটের সৃষ্টি হওয়ায় রাজধানীবাসীকে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য সময় হাতে নিয়ে বের হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ‘কুইক রেসপন্স’ টিম মাঠে নেমেছে। কাজ করছেন ৫ হাজারের বেশি পরিচ্ছন্নতা কর্মী।

ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন বলেন, ঢাকার ১০টি অঞ্চলে ১০টি কুইক রেসপন্স টিম কাজ করছে। যারা বিভিন্ন ক্যাচমেন্ট এলাকায় কাজ করছে। কিন্তু, অসুবিধা হচ্ছে যেসব পয়েন্ট থেকে আমরা ড্র্ইেনেজ সিস্টেম পরিষ্কার করি, সেই পয়েন্টগুলোতে মানুষ বিভিন্ন ধরনের আবর্জনা ফেলায় এলাকাভিত্তিক জলাবদ্ধতা নিরসনে সময় লাগছে। তবে বড় সড়কগুলোতে জলাবদ্ধতা কমেছে। যেসব এলাকায় আমরা ড্রেনেজের কাজ করেছি, সেসব জায়গায় কিন্তু জলাবদ্ধতা নেই। বা থাকলেও দ্রুত কমে যাচ্ছে।

অল্প সময়ে নিরবচ্ছিন্ন ভারী বৃষ্টি হওয়ায় পানি অপসারণ হতে কিছুটা সময় লাগছে জানিয়ে মকবুল হোসাইন বলেন, এখনো যেসব অঞ্চলে জলাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে কুইক রেসপন্স টিম পাঠিয়ে সেই সব অঞ্চলের ড্রেন পরিষ্কার করে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে। প্রতিটি অঞ্চলের শাখা রাস্তাগুলো থেকে পানি সরাতে কাজ চলছে। এছাড়া কোথাও কোনো পানি জমে থাকলে ডিএনসিসির হটলাইন ১৬১০৬ এই নম্বরে ফোন করার অনুরোধ জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনও। পানি নিষ্কাশনে কাজ করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও।

দক্ষিণের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বলেন, পানি দ্রুত নিষ্কাশনের জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০০টি টিম সকাল থেকে কাজ করছে। এছাড়া দোলাইর পাড় ও কমলাপুরে পাম্প চালু আছে। ঢাকায় বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে গ্যাস সংকটও। সকালে বাসাবাড়িতে চুলায় গ্যাসের চাপ না থাকার কারণে বৃষ্টির মধ্যেই অনেকে বাধ্য হয়ে খাবার কিনতে বের হয়ে বিপাকে পড়েন।

সেগুন বাগিচার বাসিন্দা হাসান আলী বলেন, বাসায় গ্যাস নেই। সকাল বেলা উঠে বৃষ্টি দেখি। তাও উপায়ান্তর না দেখে ছাতা নিয়ে বের হলাম। কারণ বাচ্চারা কেউ নাস্তা করেনি। কিন্তু সেগুন বাগিচার কোনো হোটেল খোলা পেলাম না। কি যে ঝামেলায় পড়লাম? হাতে গোণা কিছু প্রাইভেটকার আর মিনিবাস চলতে দেখা গেছে শান্তিনগরের রাস্তায়। সেগুলো চলার সময় যেভাবে পানি ছিটিয়েছে, তাতে রাস্তার ময়লা পানিতে ভিজে একাকার হয়েছেন ফুটপাত ধরে যাওয়া লোকজন।

শান্তিনগরের ফুটপাত ধরে যাওয়া মিন্টু বলেন, পানির ঢেউ দেখে মনে হচ্ছে সমুদ্রের ঢেউ। বাস যাওয়ার সময় গাড়ির স্পিডে ময়লা পানিতে আমার সব জামা কাপড় ভিজে গেছে। পানি ঢুকেছে শান্তিনগরের বাজারের ভেতরেও।

সেখানকার মাংস বিক্রেতা আমিন মিয়া বলেন, এক সাবে (সাহেব) মাংস নেবেন, কিন্তু দেখা নেই। বাজারে পানি উঠছে। রিকশাচালকদের ভাষ্য, এই পানি দিয়ে রিকশা বেশিক্ষণ টানাই দায়। কাকরাইলের কাছের ফুটপাতেও পানি ওঠে সকালে। সেই ফুটপাত আবার খানাখন্দে ভরা। পানি মাড়িয়ে ফুটপাত ধরে চলা কারো কারো গর্তে পা পড়ে পড়েও গেছেন। রিকশাচালক হাফিজ রামপুরা থেকে একজন যাত্রী নিয়ে শাহজাহানপুর এসেছেন সকাল ৯টায়। তিনি বলেছেন, রামপুরা, বাড্ডার নিচু এলাকায় বাসার নিচতলায় পানি ঢুকেছে। রামপুরার কাছে আমি দোকানের শার্টার অর্ধেক পানির নিচে দেখেছি।

কাকরাইলের মোড়ে গুলশান থেকে আসা প্রাইভেটকারের চালক সোলায়মান কবির বলেন, সকাল ৯টায় রওনা দিয়ে কাকরাইল এসেছি। আসার পথে পানি দেখে তিন বার পথ পরিবর্তন করেছি। যে পথেই যাই সেই পথে পানি। বেশি পানি দিয়ে গাড়ি চালালে ইঞ্জিনের সমস্যা করে। হঠাৎ যদি গাড়ি বন্ধ হয়ে যায় আরেক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। বৃষ্টি হলে জমে যাওয়া পানি নামতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে জানিয়ে কাজলার হালটপাড় এলাকা নিবাসী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এখানের খাল দিন দিন সরু হচ্ছে দখলদারদের কারণে। পানি যে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়বে তা বাধা পায় জায়গায় জায়গায়। আমরা নিম্নাঞ্চলের পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের তালিকায় সবার নিম্নে আছি। তাই জনগণের দুর্ভোগ নিয়ে মাথা ঘামায় না কেউ।

সিটি করপোরেশনের তালিকাভুক্ত হয়েও ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডে গত পাঁচ বছরে কোনো উন্নয়ন বরাদ্দ দেখেননি ওই ওয়ার্ডের বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন হওয়ার পরে আমাগো এলাকায় কোনো কাজ হয়নি। খালের সঙ্গে কয়েকটা ড্রেনের লাইন করে দিলে পানি জমতে পারত না। আমাগো কোনো উন্নয়ন হয়নি।

বৃষ্টিতে কেন বারবার ডুবছে ঢাকা এমন প্রশ্নে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, আমাদের আসলে উন্নয়নের পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে গেছে। এই উন্নয়ন হচ্ছে ধ্বংসাত্মক উন্নয়ন।

ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, আমাদের ঢাকা শহরে খাল বা জলাশয় এখন ৫ শতাংশের নিচে। আর সবুজ ৭ ভাগের নীচে। ফলে, পানি নিষ্কাশনের সুযোগ নেই। যদি, জলাশয় ভরাট করা না হতো এবং পর্যাপ্ত সবুজ থাকত, তাহলে হয়ত এমন চিত্র হতো না। কংক্রিট নিয়ে আমরা একটা গবেষণা করেছিলাম, যেখানে ঢাকার উন্নত এলাকাগুলোতে ৮০ শতাংশের ওপর কংক্রিট। কোথাও-কোথাও ৯০ শতাংশ। ফলে, পানি নিষ্কাশনের সুযোগ নেই। এই জলাবদ্ধতা আমাদের মেনে নিতেই হবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান আরও বলেন, আমরা যেটা করতে পারি, যে ড্রেনেজ সিস্টেম এবং জলাশয় অবশিষ্ট আছে, সেগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা করে জলাশয় ভরাট করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

 

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version