১৫ বছর ধরে অসহায় ৩শ সাংবাদিক পরিবার

মিরপুরে সাংবাদিকদের ২১ বিঘা জমি এখনও ইলিয়াস মোলাহ’র দখলে

ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
মিরপুরে সাংবাদিকদের ২১ বিঘা জমি এখনও ইলিয়াস মোলাহ’র দখলে

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পালানোর পরপরই পালিয়েছেন মিরপুরের আলোচিত আওয়ামী লীগ দলীয় ঢাকা-১৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দীন মোল্লাহ। প্রায় ৫ মাস আগে তিনি পালালেও প্রায় ৩০০ সাংবাদিক পরিবারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া ২১ বিঘা জমি এখনও নিজ দখলে রেখেছেন ওই ইলিয়াস মোল্লাহ। মিরপুরের পল্লবীতে ঢাকা সাংবাদিক সমবায় সমিতিকে পল্লবীর ঝিলপাড় মসজিদের পাশে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ সাত একর জমিতে বস্তি বসিয়ে, গরুর খামার বানিয়ে জবরদখল বহাল রেখেছেন তিনি। ফলে ১৫ বছরেও নিজেদের জমিতে যেতে না পেরে ৩শ সাংবাদিক পরিবারে নেমে এসেছে চরম হতাশা।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে ২০০৫ সালে মিরপুরের পল্লবীতে ঢাকা সাংবাদিক সমবায় সমিতিকে পল্লবীর ঝিলপাড় মসজিদের পাশে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ৭ একর জমি বরাদ্দ দেয়। সাংবাদিকরা সরকার কর্তৃক ধার্যকৃত অর্থ ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারকে পরিশোধ করেন। বরাদ্দকৃত জমির টাকা জোগাড় করতে ২০০৬ সালের অক্টোবরে অধিকাংশ সাংবাদিক ধার-দেনা করে জোগাড় করেন। অনেকে তাদের পরিবারের মূল্যবান স্বর্ণালংকার বিক্রি করেন, কেউ বা গ্রামের বাড়ির ভিটে-মাটি বিক্রি করেন। পরবর্তীতে নামজারি করা হয় সমিতির নামে এবং চলতি বছর পর্যন্ত খাজনা পরিশোধ করে আসছে সমিতি। জমির নিবন্ধন সম্পন্নের পর সাংবাদিকরা ওই জমিতে মাটি ভরাট শুরু করে। নির্মান করেন অস্থায়ী স্থাপনা। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ঢাকা-১৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দীন মোল্লাহ সেই জমি দখলে নিয়ে গড়ে তোলেন বস্তি ও ‘আইয়াজ এগ্রো ফার্ম’ নামে গরুর খামার। সেখানে দোকান ও অস্থায়ী মার্কেট করার পর সেখানে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ওয়াসার পানি সংযোগেরও ব্যবস্থা করেন ইলিয়াস। এসব স্থাপনা ঘিরে সেখানে মাদক ও অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা শুরু হয়। টানা চার মেয়াদে ইলিয়াস মোল্লাহ এমপি থাকাকালে সেই জমির দখল বজায় রাখেন তিনি। এই জমি উদ্ধারে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে বারংবার ধর্না দিয়েছেন সাংবাদিক নেতারা। কিন্তু ওই সমিতির অধিকাংশ সদস্য আওয়ামী লীগ সমর্থক না হওয়ায় সাংবাদিকদের পক্ষে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে গেছেন ইলিয়াস মোল্লাহ ও তার ঘনিষ্ঠজনরা। কিন্তু এখনো বহাল তবিয়তে আছে তার অবৈধ দখল। মিরপুর তল্লাটের যেসব জমি তিনি দখল করেছেন, তাতে রয়েই গেছে রাজত্ব। পালিয়ে থাকলেও ইলিয়াস মোল্লাহর লোকজন নিয়মিত ভাড়া তুলছেন বস্তি থেকে।

এদিকে নিজেদের জন্য বরাদ্দ হওয়া জমির দখল বুঝে পেতে ঢাকা সাংবাদিক সমবায় সমিতির নেতারা গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হয়েছেন বলে জানা গেছে। দ্রুত এখানকার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে জমির দখল বুঝে পেতে চান সাংবাদিকরা। জানা গেছে, ইতোমধ্যে বরাদ্দপ্রাপ্তদের মধ্যে ৫০ জন সাংবাদিক মারা গেছেন। যারা বেচে আছেন তাদের মধ্যে কারো কারো বয়স ৮০’র উপরে। আর বাকিরা পঞ্চাশোর্ধ।

ঢাকা সাংবাদিক সমবায় সমিতির সভাপতি সদরুল হাসান বলেন, সাংবাদিকদের জন্য সরকারের বরাদ্দ দেওয়া জমি দখলমুক্ত করতে বহুবার গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হয়েছি। একপর্যায়ে জমির কিছু অংশ আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হলে সেখানে অস্থায়ী স্থাপনা তৈরি করা হয়েছিল। আনসার নিয়োগ করা হয় জমি পাহারার জন্য। কিন্তু কিছুদিন পরই ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ লোক পাঠিয়ে তা ভেঙে দেন। আনসারদের থাকার ঘরটা পর্যন্ত দখল করে নেন তিনি। পুরো জমি দখলে নেন তিনি। তখনকার ক্ষমতাসীন সরকারের বিভিন্ন মহলের কাছে ধর্না দিয়েও জমি উদ্ধার করা যায়নি। সেসময়কার সরকার আমাদের ৩শ পরিবারের অসহায়ত্বে কর্ণপাত করেনি। এই সাংবাদিক নেতা বলেন, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পর ২৮ আগস্ট গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছে জমি উদ্ধারে পদক্ষেপ নিতে আবেদন করেছি। গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করলে পুলিশ সংকটের কারণে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন।’

এদিকে স্বৈরাচার সরকারের পতনের এতদিন পরও নিজেদের জমি বুঝে না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সাংবাদিকরা। তারা এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

জানা গেছে, সাংবাদিকদের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গায় বসানো দোকান, বস্তি থেকে ইলিয়াস মোল্লার বোনের ছেলে সালমান মোল্লা চাঁদা তোলেন। তথ্যানুযায়ী, শুধু বিদ্যুৎ বিল বাবদই বস্তিবাসীর কাছ থেকে প্রতি মাসে চার লাখ টাকা করে চাঁদা তোলেন সালমান মোল্লা। আর বস্তির পূর্ব পাশের অবৈধ স্থাপনা থেকে তার মাসিক আয় অন্তত তিন লাখ টাকা।

ইলিয়াস মোল্লার ছোট ভাই আলী মোল্লার দেহরক্ষী চিকন হারিসের নেতৃত্বে সাব্বির ও গাজী নামের দুই ব্যক্তি ওই জায়গার পশ্চিম পাশে নির্মিত স্থাপনা থেকে বস্তি ও দোকান ঘর ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে তিন লাখ থেকে চার লাখ টাকা চাঁদা তোলেন।

এদিকে বস্তি এলাকায় সোহেল, ফারুক ও আনোয়ার নামের লোকদের নিয়ে মাদকের কারবার করে আসছেন আলোকদি এলাকার স্থানীয় সন্ত্রাসী সামছু। নোয়ার ও ফারুক নামে দুজনের টং দোকান মাদক বিক্রির জন্য ব্যবহার করা হয়।

অন্যদিকে ঝিলপাড় নতুন রাস্তা নিয়ন্ত্রণ করেন সালমান মোল্লার ড্রাইভার ফজলু। মন্দির থেকে মোড় পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করেন আলী মোল্লার অফিসের স্টাফ বেলাল ও মাসুদ। জসিম মোল্লার হয়ে বস্তি নিয়ন্ত্রণ করেন তুফান। আর ইলিয়াস মোল্লার ভাগ্নে সালমান মোল্লার হয়ে টাকা ওঠান ড্রাইভার ফজলু। জসিম মোল্লার হয়ে টাকা ওঠান তুফান। আর আলী মোল্লার হয়ে টাকা ওঠান বিল্লাল।

স্থানীয়রা জানান, নিজের নির্বাচনী এলাকা হওয়ায় ১৫ বছর ধরে ইলিয়াস মোল্লাহর কথার বাইরে কিছুই হতো না। জমি ছাড়াও বহু দোকান, মার্কেট, বাসস্ট্যান্ড ও ফুটপাত দখলে নিয়েছেন তিনি। এ নিয়ে অভিযোগ দিয়েও তেমন কোনো লাভ হয়নি। শুধু তাই নয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে স্থানীয় সন্ত্রাসী ও নেতাকর্মীদের মিরপুর এলাকায় অতর্কিত হামলার নির্দেশদাতা ইলিয়াস মোল্লাহ। তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে হত্যাসহ একাধিক মামলা হয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য