পাহাড়, টিলা, হাওর, বনের জেলা হবিগঞ্জ। তবে এই জেলার আরেকটি পরিচয় রয়েছে; যা হলো চা উৎপাদন। এ জেলায় রয়েছে ২৪টি চা বাগান। চলতি বছর এ জেলায় রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদন হয়েছে। তবে চা উৎপাদন বাড়লেও কাঙ্ক্ষিত মূল্য মিলছে না বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। একই সঙ্গে উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় ক্রমেই লোকসানের দিকে যাচ্ছে বৃহৎ এই শিল্পটি।
বাগানসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে চাহিদা কমে যাওয়া এবং ভারত থেকে অবৈধপথে নিম্নমানের চা দেশে প্রবেশ করায় এমনটি ঘটছে। সংকট উত্তরণে ভর্তুকি ও সরকারি প্রণোদনা বাড়ানোর পাশাপাশি ভারত থেকে অবৈধপথে চা দেশে প্রবেশ ঠেকানোর দাবি তাদের।
বাংলাদেশ চা বোর্ড থেকে জানা যায়, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট, মাধবপুর, বাহুবল এবং নবীগঞ্জ উপজেলায় ২৪টি চা বাগান রয়েছে। ২০২১ সালে এখানে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছিল ১ কোটি ২৫ লাখ কেজি। উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৩৫ লাখ কেজি। এসব চা বাগানের ওপর নির্ভরশীল ৭৫ হাজার শ্রমিক।
চা বোর্ড থেকে আরো জানা যায়, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ২০২০ সালের তুলনায় ২১ সালে চায়ের উৎপাদন তুলনামূলক ভালো হয়েছে। ২০ সালে দেশে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ কোটি ৭৭ লাখ কেজি। কিন্তু ১০ মাসেই উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে দেশের বাগানগুলো। গেল বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে ৭ কোটি ৯৩ লাখ কেজি।
বাগানসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, চা উৎপাদন বাড়লেও দেশের বাজারে বিক্রি অনেক কম গেছে। যে কারণে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত দাম। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট ও মাধবপুর সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারত থেকে দেশে প্রবেশ করছে নিম্নমানের চা পাতা। নিম্নমানের এসব চা পাতা কম দামে বাজারে বিক্রি হওয়ায় ভোক্তা পর্যায়ে এর চাহিদা বেশি। যে কারণে একদিকে যেমন দেশীয় চায়ের ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে না, অন্যদিকে দেশের বাজারে কমেছে চাহিদাও।
বাগান মালিকরা বলছেন, লোকসানের কারণে শ্রমিক ছাঁটাই করতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না শ্রমিকের মজুরি ও অন্য সুযোগসুবিধা।
হবিগঞ্জের দেউন্দি চা বাগানের ব্যবস্থাপক মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে এ বছর চায়ের উৎপাদন বেশি হয়েছে। কিন্তু এরপরও বাগান লোকসানে আছে। কারণ চা পাতা উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত করতে আগের চেয়ে অনেক বেশি খরচ বেড়েছে। যেমন ডিজেল, কয়লার ও পরিবহণসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। সেই অনুপাতে চায়ের দাম বাড়া তো দূরের কথা, উল্টো কমে গেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘উৎপাদন খরচ কমাতে চা বাগানের যে রাস্তাঘাট-কালভার্ড রয়েছে, সেগুলো নির্মাণ এবং সংস্কারের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। এ ছাড়া শ্রমিকদের উন্নয়নে কাজ করলে উৎপাদন খরচ কিছুটা কমবে।’
মাধবপুরের তেলিয়পাড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক ও লস্করপুর চা ভ্যালী চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘চুনারুঘাট ও মাধবপুর সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে প্রতিনিয়ত নিম্নমানের চা পাতা দেশে প্রবেশ করছে। এসব চা পাতার দাম কম হওয়ায় চাহিদা বেশি। যে কারণে দেশীয় পাতা বেশি দামে কেউ কিনতে চায় না। তাই চা শিল্পকে বাঁচাতে প্রথমে ভারত থেকে চা প্রবেশ ঠেকাতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালে কেজিপ্রতি চায়ের গড় মূল্য ছিল ২৬২ টাকা। কিন্তু ২০২০ সালে খরচ বাড়লেও চায়ের মূল্য নেমে যায় ১৮৯ টাকায়। অথচ এ অবস্থায় চা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়ের ন্যূনতম ২৫০ টাকা এবং পরবর্তীতে মানের ওপর ভিত্তি করে দাম নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি এই শিল্পে ভর্তুকিসহ সুযোগসুবিধা বাড়াতে হবে।’
ফিনলে চা কোম্পানি চিফ অপারেটিং কর্মকর্তা (সিওও) তাহসিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘নানা রকম সংকটে পড়েছে চা শিল্প। তাই এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য চা শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে এই শিল্পে ভর্তুকি ও সরকারি নানা প্রণোদনা বাড়ানো খুবই জরুরি।’
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘বাংলাদেশের চা কিন্তু লিকার বলেন, কোয়ালিটি বলেন, অতন্ত ভালো। কিন্তু ভারত থেকে নিম্নমানের চা প্রবেশ করায় আমাদের চায়ের দাম কমে যাচ্ছে। ফলে লোকসানে পড়ছেন বাগান মালিকরা। তাই ভারতীয় চা দেশে প্রবেশ ঠেকাতে আরও কঠোর হতে হবে।’
মন্তব্য