‘বীরাঙ্গনার কোনো দাম নাই। কত বছর ধইরা জীবনের লগে যুদ্ধ কইরা বাইচ্ছা আছি, তবুও কেউ খবর নেয় নাই। পাঁচ বছর আগে মরণঘাতী ক্যানসারে আক্রান্ত হইছি। থাকতাছি একটা পরিত্যক্ত ঘরে। প্রশাসনের কাছে আবাস ও চিকিৎসার অর্থ সহায়তার আবেদন করছি।
‘সমাজসেবা অধিদপ্তরে আবেদন কইরা ভুল করছি। তাদের অফিসে দৌড়াদৌড়ি কইরা পায়ের জুতা ক্ষয় করছি। আশ্বাস ছাড়া সহায়তা দিছে না কেউ!’
চোখের পানি মুছতে মুছতে ভোরের আকাশের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন বীরাঙ্গনা রেজিয়া বেগম কমলা। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার নওবাইত গ্রামের মৃত আবদুল আজিজের মেয়ে। বর্তমানে ময়মনসিংহ নগরীর ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের চরকালীবাড়ি মিলগেট এলাকায় রেলওয়ের পরিত্যক্ত জমিতে বসবাস করছেন।
তার বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির ভেতর সুনসান নীরবতা। ঘরের সামনের কিছু অংশে ইটের দেওয়াল। তবে উঠানের সামনে রয়েছে ঝোপঝাড়ে ঘেরা একটি পুকুর। বীরাঙ্গনা একা বসে আছেন ঘরের ভেতর। ডাক দিতেই তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বের হন তিনি।
কেমন আছেন জানতে চাইতেই বীরাঙ্গনা রেজিয়া বেগম কমলা বলেন, ‘দশ বছর যাবত এই এলাকায় সরকারি পরিত্যক্ত জমিতে থাকতাছি। উঠানের সামনে বড় পাগার (পুকুর)। এইহানে মানুষ থাহার জাগা (জায়গা) না। ভালা একটা জাগাতে সরকারি ঘর কইরা দিলে মরার আগে শান্তিতে ঘুমাইবার পারতাম। মনে অয় এই ইচ্ছা আমার পূরণ অইতোনা।’
তিনি বলেন, ‘আমার যেহেতু ক্যানসার ধরছে আমি মইরা যাইয়াম। তয় মনে দুঃখ থাইক্যা গেল- অর্থের অভাবে ঠিকমতো চিকিৎসা করাইবার পারলাম না। আল্লাহ আমার একমাত্র ভরসা।’
বীরাঙ্গনা কমলা আগ্রহ প্রকাশ করেই জানালেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ওপর চলা পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের কথা। মুক্তিযুদ্ধ থেকে আজ অবধি আষ্টেপৃষ্ঠে তার চোখে ভাসে জীবনের রঙিন স্বপ্ন ম্লান হওয়ার চিত্র।
তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ছিলেন তরুণী। তাই পরিবার তড়িঘড়ি করে তাকে নানসিঁড়ি গ্রামের কৃষক মাসুদুল আলমের কাছে বিয়ে দিয়ে দেন। তখন চোখে ছিল রঙিন স্বপ্ন। শ্বশুর-শাশুড়ি আর স্বামীকে নিয়ে সুখে থাকার প্রবল ইচ্ছে। তবে স্বপ্ন আর ইচ্ছে নিমিষেই ধূলিসাৎ করে দেয় পাক হানাদার বাহিনী।
সেই দিনের কথা মনে করে জানান, তার বিয়ের সময় চারদিকে যুদ্ধ চলছিল। বিয়ের মাত্র দুইদিন পর স্বামী আর শ্বশুর ভয়ে তাকে ফেলেই ভারতে চলে যায়। পরে শাশুড়ি রাজাকার আসলামের সঙ্গে কমলাকে তার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তখন আসলামের সুন্দর কথাবার্তায় তাকে তারা বিশ্বাস করেছিল। এরপর আসলাম কমলাকে পাকিস্তানি ক্যাম্পে হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়।
তিনি আরো জানান, ক্যাম্পে একটানা তার ওপর সাতদিন চলে নারকীয় নির্যাতন। তখন অসহনীয় যন্ত্রণায় ক্যাম্প থেকে পালানোর পথ খুঁজছিলেন। কিন্তু ক্যাম্প থেকে বেড় হওয়ার সব রাস্তা ছিল বন্ধ। এমতাবস্থায় রাজাকার আসলামের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। রাজাকারও কমলার কথায় বিশ্বাস করতে থাকেন।
তখন রাজাকারের সহায়তায় কৌশলে বাইরে বের হয়ে আসেন। বের হয়ে পাশের একটি খালে কচুরিপানার নিচে লুকিয়ে পড়েন তিনি। ভোরে এলাকার মানুষ ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার কড়ইতলী সীমান্ত দিয়ে ভারতে যেতে শুরু করলে তাদের সঙ্গে তিনিও যোগ দেন। পরে অন্তত ১৬ সদস্যের মুক্তিযোদ্ধার টিমকে কমলাসহ চার নারী সহযোগিতা করতেন।
এই বীরাঙ্গনার সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, স্বাধীনতার সাত বছর পর ময়মনসিংহ নগরীর নতুনবাজার এলাকায় মোনায়েম খান এতিমখানার করনিক আবুল কাশেমের সঙ্গে আবারও সংসার পাতেন কমলা।
কাশেমের বাড়ি ছিল নগরীর দাপুনিয়া এলাকায়। ১৯৯৪ সালে স্বামী মারা যাওয়ার আট দিনের মাথায় শাশুড়ি ও ভাসুর মিলে কমলাকে সন্তানসহ বাড়ি থেকে বের করে দেয়। পরে নগরীর ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এক নারীর আশ্রয়ে থেকে চা দোকানে কাজ শুরু করেন। সেখান থেকেই সন্তানদের বড় করে তোলেন বীরাঙ্গনা কমলা।
করোনার প্রাদুর্ভাবের সময়ে কেউ সহযোগিতা করেছে কি না- এমন প্রশ্নে বীরাঙ্গনা কমলা বলেন, ‘অনেকে বীরাঙ্গনাদের ভালা চোঁখে দেহেনা (দেখেনা)। তারা ভাবে আমরা কলঙ্কিনী। কত মানুষরে চাল-ডাল দিছে নেতারা। কই, আমি তো কিছুই পাইলাম না।’
তিনি বলেন, ‘আমি ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে অর্থের অভাবে চিকিৎসা করবার পারতাছি না। কেউ অর্থের (টাকার) সাহায্য দিতাছে না। অনেক কষ্ট কইরা ঘরের সামনের দিকে দেয়াল করবার পারছি। বীরাঙ্গনাদের দাম নাই দেইখ্যা আইজক্যা আমার এই অবস্থা। আমি প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য চাই।’
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ময়মনসিংহ জেলা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দেশে বহু বীরঙ্গনা দুর্বিষহ জীবন পাড় করছে। তাদেরকে তালিকা করে সব ধরনের সরকারি সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। বীরাঙ্গনা কমলার চিকিৎসা সহায়তাসহ তার নিরাপদ আবাসন ব্যবস্থা দ্রুত নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’
এ বিষয়ে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, ‘বীরাঙ্গনা কমলার সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হবে। প্রয়োজন হলে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।’
২০১৭ সালের ১৩ জুন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন বীরাঙ্গনা রেজিয়া বেগম কমলা। প্রতি মাসে ১২ হাজার টাকা সরকারি ভাতা পাচ্ছেন তিনি। এই টাকা দিয়ে সংসার ভালোভাবেই চলছিল।
তবে হঠাৎ করে তার ক্যানসার ধরা পড়ে। চিকিৎসক বলেছেন, ছয়টা ক্যামোথেরাপি দিতে হবে। ছেলের অটোরিকশা বিক্রি করে মাত্র একটি ক্যামোথেরাপি দিয়ে টাকার অভাবে আরো পাঁচটা দিতে পারেননি।
মন্তব্য