ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেঘনা তীরবর্তী আশুগঞ্জ দেশের অন্যতম বৃহৎ চালের হাট। প্রতিদিনই এ ধান-চালের হাট ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদচারণায় মুখরিত থাকে। পাশাপাশি চলতি মৌসুমে গ্রামাঞ্চলের কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য পেয়ে অনেকটাই স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। তবে ধানের হাটে ক্রয়মূল্যের সঙ্গে চালের বিক্রয় মূল্যের ফারাক রয়েছে। এতে অনেকটা হতাশা প্রকাশ করেছেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ ধান-চালের হাটে প্রতিদিন দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, সিলেটসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিপুল পরিমাণ ধান আসে। এতে প্রতিদিন কাকডাকা ভোর থেকেই এ হাট চাঙ্গা হয়ে ওঠে। বর্তমানে বাজারে চিকন ধান হিসেবে পরিচিত বিআর২৮ ধান ১২০০ থেকে ১৩০০, বিআর২৯ ধান ১৩০০ থেকে ১৪০০ এবং মোটা ইরি ধান বিক্রি হচ্ছে ১১২০ টাকা থেকে ১১৫০ টাকা দরে। চলতি মৌসুমে ধানের ন্যায্য দাম পেয়ে লাভবান হচ্ছেন প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক।
আবুল কাসেম নামে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার এক কৃষক বলেন, ‘আগে ধানের দাম একটু কম ছিল এ বছরে ধানের দাম ভালো। সরকার যদি আমাদের ধানের দাম আরো বাড়িয়ে দেয় আগামীতে আরো বেশি ধান করব।’
কৃষক দুলাল মিয়া বলেন, ‘শুকনা ধান হাজার থেকে ১১০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। যদি এ দাম থাকে, তাহলে কৃষকের জীবন বাঁচবে। আর ধানের দাম কমে গেলে কৃষকের অনেক ক্ষতি হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ধান কাটার শ্রমিকদের টাকা দিয়ে বেশি একটা লাভ হয় না। তাই আমরা চাই এমন দাম যেন সবসময় থাকে।’
এদিকে গ্রামাঞ্চলের কৃষকের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে ধান কিনছেন বেপারিরা। কিন্তু হাটে এসে মিল মালিকদের কাছে ন্যায্যমূল্যে ধান বিক্রি করতে পারছে না। অন্যদিকে মিল-মালিকরা বলছেন, ধানের দাম বেশি হওয়ায় ধান থেকে চাল উৎপাদন করতে গিয়ে লোকশানের মুখে পড়ছেন তারা। হাটে ধান নিয়ে আসা বেপারি সিদ্দিক মিয়া বলেন, ‘বিআর২৯ ধান ১৩০০ টাকা দরে কিনে আনছি। এখন বাজারে বিক্রি করতে হয়েছে ১২২০ টাকা দরে।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘সরকার ২০ থেকে ৫০ টাকা হঠাৎ করে বাড়ায় আবার কমিয়ে দেয়। বাজারে ধানের দাম বাড়বে, এ আশায় ধান কিনেছি। কিন্তু বাজারে এসে বেশি দাম পাওয়া যায় না। এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ ধান কিনে বিক্রি করেছি, সবদিকেই লোকসান হয়েছে। আর মোকামে গেলে কৃষক কম দামে ধান বিক্রি করতে চান না।’
ইসমাইল মিয়া নামে আরেক বেপারি বলেন, বিআর২৯ ধান ১৪২০ টাকা দরে কিনছি। এখানে বিক্রি করতে হয় ১৩৭০ টাকা দরে। প্রতি মণে ৫০ টাকা করে লোকসান হচ্ছে। আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। প্রতি বছরই ব্যবসায় এভাবে লোকসান দিতে হয়। ব্যবসা করতে হয় তাই করছি।’
এদিকে মিল মালিক জয়নাল বলেন, ‘ধানের দাম বাড়তি। ধান থেকে চাল করে লাভ হয় না। বেশিরভাগ মিল বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিগুলো কোনো রকম টিকে আছে। যে দামে ধান কিনছি, তাতে ধানের ও চালের দামে পর্তায় পড়ছে না। ধান থেকে চাল তৈরি করে বিক্রি করতে গেলে দাম অনেক কমে যায়। আমরা যারা মিলার তাদের কোনো দিকেই হিসেব মিলে না। পুরোনো ধানের দাম বেশি। যদি এটা সীমিত থাকত, তাহলে আমরা মিল চালাতে পারতাম।’
আবু বক্কর নামে আরেক মিল মালিক বলেন, ‘বিআর২৯ চালের মধ্যে খরচ হয় ২৪০০ টাকা, কিন্তু ২২৭০ টাকার বেশি বিক্রি করা যায় না। প্রতি মণে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা ক্ষতি হয়। মিল মালিকরা অনেক টাকা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ব্যবসা করছে। এভাবে যদি লোকসান হয়, তাহলে ব্যাংকের লোন দেওয়া সম্ভব হবে না। ধান চালের বাজারকে চাঙ্গা করতে হলে ভারতসহ বিদেশ থেকে চাল আমদানি বন্ধ করতে হবে।’
এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুবীরনাথ চৌধুরী বলেন, ‘এ বছর ১ হাজার ৮০ টাকা মণ দরে ২ হাজার ৭৩৪ টন ধান কেনা হবে। একইভাবে ৪০ টাকা দরে ১৪ হাজার ৪২০ টন চাল সংগ্রহ করা হবে। বর্তমানে ক্রয় অভিযান চলছে। আগামী ২৮ ফেব্রয়ারি পর্যন্ত অভিযান চলবে। আশা করছি, এর মধ্যেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।’
গত আমন মৌসুমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের আবাদকৃত ৫১ হাজার ৪৬৯ হেক্টর জমি থেকে ২ লাখ ৪৭ হাজার টন ধান উৎপাদন করা হয়, যা থেকে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫০৬ টন চাল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ।
মন্তব্য