বনের বৃহৎ আকারের প্রাণি হাতি। এই প্রাণিকে বশে এনে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করছে মানুষ। পাহাড় থেকে গাছ টানা, সার্কাস, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খেলা ও শারীরিক কসরত দেখানোর জন্য হাতিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে এ প্রশিক্ষণের নামে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় প্রতিনিয়ত অমানবিক নির্যাতন করা হচ্ছে বিভিন্ন হাতিকে। সম্প্রতি ‘টাইগার’ নামে দুই বছর বয়সী এক হাতি শাবককে নির্যাতনের তথ্য পেয়েছে ভোরের আকাশ।
জুড়ী উপজেলায় গত ২৪ জানুয়ারি থেকে ‘টাইগার’কে পোষ মানানো হচ্ছে। উপজেলার গোয়ালবাড়ি ইউনিয়নের কাটাগাং গহীন জঙ্গলে হাতির বাচ্চাটিকে বেঁধে পোষ মানানো নামে চলছে শারীরিক নির্যাতন। ২৫ জানুয়ারি বন বিভাগের লোকজনের উপস্থিতিতে নির্যাতন সাময়িকভাবে বন্ধ হয়। তবে বনবিভাগের লোকজন চলে গেলে পুনরায় শুরু হয় নির্যাতন।
স্থানীয়রা জানান, হাতির বাচ্চাটিকে বাঁধার কৌশলটা ব্যতিক্রম। আগে থেকেই মাটিতে গাছের চারটি খণ্ড পুঁতে রাখা হয়। নির্ধারিত স্থানে যাওয়া মাত্র প্রথমে শাবকের গলায় রশি দিয়ে গাছের সঙ্গে বাঁধা হয়। সামনের দুই পা সামনের গাছের সঙ্গে এবং পিছনের দুই পা পিছনের গাছের সঙ্গে রশি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হয়। এ সময় বাচ্চার গগনবিদারী চিৎকার দিতে থাকে এবং সমস্ত বাঁধন ছিন্ন করে মুক্ত হবার প্রাণপন চেষ্টা করে। এভাবে বেঁধে দিনের পর দিন শারীরিক আঘাত করে বশে আনার নামে চলছে নির্যাতন। এতে করে হাতি শাবকের পাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে পচন ধরেছে। চিকিৎসার নামে বিভিন্ন গাছের লতাপাতা লাগানো হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী পরিবেশ কর্মী মোহাম্মদ ইমরান খান বলেন, ‘হাতি শাবককে যেভাবে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে এবং প্রশিক্ষণের নামে যা হচ্ছে তা অমানবিক। আমি স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করেছি।’
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এখানে বছরের পর বছর এভাবে নির্যাতন করে হাতিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এক একটি হাতি শাবককে দুই থেকে তিন মাস সময় নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে শাবকটি অনেক শুকিয়ে যায়। অসুস্থ হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। এর সঙ্গে হাতির শরীরের বিভিন্ন স্থানে পচন ধরে। এসব অংশে মরিচের গুঁড়া ও বিভিন্ন লতাপাতার রস ব্যবহার করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা জয় সরকার বলেন, ‘এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হাতির বাচ্চাকে বিভিন্ন সংকেত বুঝিয়ে দেয়া হয়, শিখিয়ে দেয়া হয় বিভিন্ন কাজের কৌশল। বনের গভীরে এসব প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, ফলে বনবিভাগসহ অনেকেই তা জানে না।’
মাহুত (হাতির রাখাল) আহমদ আলী পংকী জানান, প্রশিক্ষক আকবর আলীর নেতৃত্বে সহকারী প্রশিক্ষক রহমত আলী, ইছমাইল আলী, ফুলু মিয়া ও আহমদ আলী পংকীসহ কয়েকজন এ প্রশিক্ষণ কাজে অংশ নিয়েছেন।
প্রশিক্ষক আকবর আলী বলেন, ‘তিন মাস পরেও প্রশিক্ষণের আরো কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে। তা সঠিকভাবে সম্পন্ন হবার পর এই হাতিকে দিয়ে যে কোনো কাজ করানো যাবে।’
প্রশিক্ষণে হাতির কষ্ট হয় কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে আকবর আলী বলেন, ‘প্রশিক্ষণকালে হাতির কষ্ট তো হবেই। প্রাণিগুলোর শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ক্ষত বা পচে গেলে পাহাড়ি গাছের লতাপাতা পিষে ক্ষতস্থানে লাগালে তা সেরে যায়।’
‘টাইগার’ নামক শাবক হাতিটির মালিক উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়নের বিশ্বনাথপুরের নিপার রেজা। তিনি বলেন, ‘হাতি প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়াটি বাচ্চার জন্য কষ্টদায়ক। তবুও তাকে পোষ মানানোর এ কাজটি না করলে এটি জংলি হাতির মতো আচরণ করবে। মানুষের জান-মালের ক্ষতি করবে। প্রশিক্ষণের জন্য এর চেয়ে ভালো পদ্ধতি এখনো বাংলাদেশে নেই। প্রশিক্ষণকালে অসুস্থতার কারণে বাচ্চাকে স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার ওষুধ খাওয়াতে হয়।’
সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘জুড়ীর হাতির বাচ্চা ‘টাইগারকে রেঞ্জারের উপস্থিতিতে বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। আমরা বলেছি তাদের নির্যাতন না করতে। আমরা নজর রাখছি, পুনরায় যেন নির্যাতন না করা হয়।’
সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী পোষা হাতিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে। তবে প্রশিক্ষণকালে তাকে নির্যাতন করা যাবে না। বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য দেশে দেশে নির্যাতন ছাড়াই হাতিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
মন্তব্য