-->
শিরোনাম
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘর

শত বছরের বিচিত্র সংগ্রহ

জুয়েল রহমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
শত বছরের বিচিত্র সংগ্রহ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুস্তক বিক্রেতা সমিতির সহসভাপতি মমিনুল হক বাবু। বছরপাঁচেক আগে ইতালি প্রবাসী বন্ধু মাহমুদুর রহমানের কাছ থেকে একটি কোরআন শরিফ উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন তিনি। যার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ প্রায় দুই ইঞ্চি করে। এ উপহার তিনি তুলে দিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘর কর্তৃপক্ষের হাতে। সেখানে গেলেই দেখা মিলবে ক্ষুদ্র আকৃতির এই পবিত্র গ্রন্থ।

জমিদার পরিবারের সন্তান সরজনি। রানি এলিজাবেথের সঙ্গে ছিল তাদের পারিবারিক সম্পর্ক। ১৯৩৭ সালে রানি এলিজাবেথ শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে পাঠান দুটি পেয়ালা। নিজ নামে করা বিদ্যালয়ে সে দুটি পেয়ালা স্থান পায়। কালক্রমে বিদ্যালয়ে নাম হয় মডেল গার্লস স্কুল। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পারভীন বেগমের কাছ থেকে সংগ্রহ করে পেয়ালা দুটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘরে এনে রাখেন জহিরুল ইসলাম স্বপন।

১৩ জানুয়ারি উদ্বোধন হওয়া জাদুঘরে এসব ছাড়াও শত বছরের পুরনো ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির নানা উপকরণ রয়েছে। সেখানে রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক নিদর্শন। এখানে থাকা একটি জীবাশ্ম লাখো বছর আগের বলে দাবি করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বছর দুয়েক আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে একটি জাদুঘর করার মূল পরিকল্পনা শুরু হয়। এগিয়ে আসেন সদ্য বদলি হওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খাঁন। স্থানীয় কয়েকজনকে দায়িত্ব দেন মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির উপকরণ সংগ্রহের জন্য। জায়গার দায়িত্ব নেন তিনি নিজেই। দক্ষিণ মৌড়াইল এলাকায় সাবেক ভূমি অফিস মেরামত করে সেখানে জাদুঘরটি করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের দুই নম্বর সেক্টরের একটি ম্যাপ ওই জাদুঘরের প্রথম উপকরণ। আখাউড়া উপজেলার তন্তর গ্রামের শহিদুল হক বীরপ্রতীকের কাছ থেকে পাওয়া ওই ম্যাপটি ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর জাদুঘরে হস্তান্তর করা হয়। এরপর থেকেই আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। স্বাধীনতার সময়কার রেডিও, গ্রামোফোন রেকর্ড, ডাক বিভাগের খাম, পুরনো পয়সা, টাইপ মেশিন, লোকজ উপাদানÑ কী নেই জাদুঘরটিতে। রয়েছে বঙ্গবন্ধু, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, শহীদ সিপাহি মোস্তফা কামাল, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, বিপ্লবী উল্লাস কর দত্ত, অদ্বৈত মল্ল বর্মণের ছবি। এ ছাড়া বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানের ছবিও রয়েছে এতে। আর এসবই স্থানীয়কেন্দ্রিক।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়ার পর থেকেই স্থানীয়রা এগিয়ে আসেন। মাঠ পর্যায়ে কাজের দায়িত্বপ্রাপ্তরা ইতিহাস, ঐতিহ্যের জিনিস যার বাড়িতে আছে সেখানেই ছুটে গেছেন। জাদুঘরে দেওয়ার আহ্বান জানালে তারাও এগিয়ে এসেছেন।

হালাদরপাড়ার পাপড়ি সালের বাড়ি থেকে এনেছেন পুরনো পয়সা ও ডাকটিকিট। এর মধ্যে ১৮৮০ সালের পয়সাও রয়েছে। পাইকপাড়ার অধ্যাপক হরলাল রায়ের বাড়ি থেকে এনেছেন টাইপ মেশিন। স্টেশন রোডের ইসমাইল মিয়ার বাড়ি থেকে আনা হয়েছে ১৯৫৪ সালের একটি রেডিও, যেখানে লেখা আছে ‘পূর্ব পাকিস্তান সরকার’।

ধারণা করা হয়, পাকিস্তান আমলে জনপ্রতিনিধিদেরকে এ রেডিও দেওয়া হয়। নবীন পালের বাড়ি থেকে আনা হয়েছে ১৫০ বছরের পুরনো পিতলের হুক্কা। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের কাছ থেকে রেখে দেওয়া প্রাথমিক চিকিৎসার ও গুলির বাক্স জাদুঘরে রাখা হয়েছে। সম্প্রতি হেফাজত তাণ্ডবে পুড়ে যাওয়া বইও স্থান পেয়েছে জাদুঘরটিতে।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পৌর এলাকার দক্ষিণ মৌড়াইলে এক সময় সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয় ছিল। পরে ভূমি কার্যালয় পুরনো জেলা রোডে স্থানান্তরিত করা হয়। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই ভবনটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। সেখানেই জাদুঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেয় জেলা প্রশাসন। বিভাগীয় কমিশনারের টিআর কর্মসূচি, জেলা প্রশাসকের বিশেষ বরাদ্দ ও বিভিন্ন মাধ্যমে জাদুঘর নির্মাণের অর্থ জোগাড় করা হয়। জাদুঘর নির্মাণে প্রায় ২০ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জাদুঘরের প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চারপাশে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। দক্ষিণ দিকের পাকা ভবনে জাদুঘর। ভবনের প্রথম কক্ষটি অভ্যর্থনা কক্ষ। এর পাশেই তিনটি কক্ষ। প্রথম কক্ষের ওপরে লেখা মুক্তিযুদ্ধ, দ্বিতীয় কক্ষে ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং তৃতীয় কক্ষে সংস্কৃতি লেখা রয়েছে।

জাদুঘরের উপকরণ সংগ্রহে কাজ করা উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি জহিরুল হক স্বপন বলেন, প্রায় দুই বছর ধরে আমরা কয়েকজন এ নিয়ে কাজ করেছি। আমার সঙ্গে মাঠ থেকে কাজ করেছেন ফারুক আহমেদ ও ফেরদৌস রহমান। এছাড়া কবি জয়দুল হোসেন, লেখক রেজাউল করিম, এসআরএম ওসমান গণি সজিব, মমিনুল হক বাবু নানাভাবে পরামর্শ দিয়েছেন। জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খাঁনের পাশাপাশি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. রুহুল আমীন এ কাজে নিয়মিত তদারকি করেছেন। ধীরে ধীরে একটি সমৃদ্ধ জাদুঘর হিসেবে আমরা গড়ে তুলতে পারব বলে আশা করি।

জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক আবদুন নূর বলেন, ‘এই জাদুঘরের কারণে পরবর্তী প্রজন্ম জেলার মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিষয়গুলো জানতে পারবে। তবে জাদুঘরটিকে আরো সমৃদ্ধ করতে হবে। এ জন্য সবার সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমির সভাপতি কবি জয়দুল হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে জেলায় একটি জাদুঘর নির্মাণের দাবি ছিল আমাদের; কিন্তু কেউই উদ্যোগটি নেয়নি। জাদুঘর নির্মাণ করায় বিদায়ী জেলা প্রশাসককে ধন্যবাদ। এর মাধ্যমে স্থানীয় জনগণ ইতিহাস, ঐতিহ্যকে জানতে পারবে।’

মন্তব্য

Beta version