-->
নীলফামারীতে ১২টি অরক্ষিত তিনটি অবৈধ লেভেল ক্রসিং

‘গেটম্যান নেই, নিজ দায়িত্বে পার হবেন’

শরিফুল ইসলাম, নীলফামারী
‘গেটম্যান নেই, নিজ দায়িত্বে পার হবেন’
নীলফামারীর দারোয়ানীর এই লেভেলক্রসিংয়ে সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনে কাটা পড়ে উত্তরা ইপিজেডের চার শ্রমিক নিহত হন

অসতর্কতা ও অসচেতনতার কারণে রেল দুর্ঘটনা বাড়ছে। কখনো বাসের সঙ্গে, কখনো মাইক্রোবাসসহ অন্য যানবাহনের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটেই চলছে। একটি দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আর একটি দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ছোট একটি সতর্কীকরণ নোটিশ টানিয়ে কর্তৃপক্ষ দায় সারে।

নীলফামারী জেলার ৬৩ কিলোমিটার রেলপথে ৩৩টি লেভেল রেলক্রসিং থাকলেও এখানে গেইটম্যান নিয়োগ দেয়া হয়েছে মাত্র ২১টিতে। বাকি ১২টি অরক্ষিত ও তিনটি অবৈধ ক্রসিং। ফলে নীলফামারী জেলায় একের পর এক বাড়ছে এ অসহনীয় মৃত্যুর মিছিল।

গত দুইমাসে এ রেলপথে প্রাণ হারিয়েছেন আটজন। সর্বশেষ গত বুধবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে নীলফামারীর দারোয়ানীতে লেভেলক্রসিংয়ে সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনে কাটা পড়ে উত্তরা ইপিজেডের চার শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ সময় গুরুতর আহত হয়েছেন অটোরিকশার চালকসহ আরো পাঁচ শ্রমিক । নিহত চার পরিবারের মধ্যে শেফালির দুটি সন্তান, রোমানা বেগমের তিন মেয়ে, মিনারার এক ছেলে এবং সায়েরার দুটি সন্তান রয়েছে। পরিবারের স্বচ্ছলতার জন্য স্বামীর রোজগারের পাশাপাশি ইপিজেডে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন নিহত নারীরা।

নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন উত্তরা ইপিজেড এর সনিক নামে একটি ফ্যাক্টরির শ্রমিক রওশন আরা (৩৪) বলেন, ‘বাড়ি থেকে সাড়ে ছয়টাই বের হই। আমরা যে অটোতে (ইজিবাইক) যাচ্ছিলাম তার চালক ট্রেনের হুইসেল শুনতে পারেননি। এ কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটে। ট্রেনের ধাক্কার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আলাদা হয়ে যাই। পরে আর কিছুই জানি না।

এর দেড় মাস আগে গত ৮ ডিসেম্বর জেলা শহরের বউবাজার এলাকায় চিলাহাটি থেকে খুলনাগামী মেইল ট্রেনে কাটা পড়ে একই পরিবারের তিন শিশুসহ মারা যান চারজন। ওই জায়গায় রেললাইন পারাপারের জন্য একটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছিল। নির্মাণ কাজের জন্য ইট নিয়ে একটি ট্রাক এলে সেটি দেখতে যায় শিশুরা। ওই সময় খুলনা থেকে ছেড়ে আসা চিলাহাটিগামী রকেট মেইল ট্রেন তাদের সামনাসামনি চলে আসে। পরে প্রতিবেশী শামীম ওই তিন ভাই-বোনকে বাঁচাতে গেলে তিনিও ট্রেনে কাটা পড়েন।

রেলওয়ে পুলিশ ও রেলওয়ে কর্মকর্তা বলছেন, প্রধানত অসতর্কতা ও বেপরোয়া পারাপারের কারণে বেশিরভাগ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সংশ্লিষ্টরা এসব মৃত্যুর জন্য প্রায় ১০টির মতো কারণ চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে অরক্ষিত ক্রসিং, অসতর্কতা, বাঁকা পথের কারণে ট্রেন দেখতে না পাওয়া, রেললাইন ধরে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটা, লাইনের দুপাশে দোকান-বাজার বা অবৈধ স্থাপনা, সিগন্যালে দায়িত্বরত লোক না থাকা অন্যতম।

স্থানীয় সূত্র জানায়, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ক্রসিংয়ের উন্নয়নে প্রকল্প হাতে নেয় ২০০৯ সালে। কিন্তু প্রকল্পটি অনুমোদন পেতে সময় লেগে যায় প্রায় ছয় বছর। অবশেষে প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও তেমন অগ্রগতি হয়নি।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, এ রেলপথের এসব ক্রসিং দিয়ে অবাধে পারাপার হচ্ছে হাজারো পথচারী ও বিভিন্ন যানবাহন। রেল বিভাগ ক্রসিংয়ের দুই পাশে সাইনবোর্ড টানিয়ে লিখে দিয়েছে, ‘এই গেটে কোনো গেটম্যান নেই। পথচারী ও সকল প্রকার যানবাহন চালক নিজ দায়িত্বে পারাপার হবেন। যেকোনো দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবেন।’ আবার অন্য সতর্কবার্তায় লেখা হয়েছে, ‘এই স্থানে রেললাইনের ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ।’

স্থানীয়রা জানান, এ রেলপথে ১২টি অরক্ষিত ও তিনটি অবৈধ ক্রসিং অতিক্রম করার সময় ট্রেনের গতি কমানো হয় না। এমনকি ট্রেনের হুইসেল পর্যন্ত বাজানো হয় না। ক্রসিংগুলো অতিক্রম করার সময় মানুষ বা যানবাহন পারাপারের বিষয়টি ট্রেনের চালকের দৃষ্টিতে এলেও ব্রেক পর্যন্ত ধরা হয় না। এতে অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে যে হারে মানুষ মারা যাচ্ছে, তাতে রেল বিভাগের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। তাই রেলপথ ও সড়ক সম্প্রসারণের সঙ্গে মানুষের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

জানতে চাইলে সৈয়দপুর রেলওয়ে পুলিশ সুপার সিদ্দিকী তানজিলুর রহমান বলেন, ‘মানুষকে সচেতন হতে হবে আর যেখানে সেখানে রাস্তা বানানো বন্ধ করতে হবে। স্থানীয় সরকার এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় দায়িত্ব নিলে রেলপথের নিরাপত্তা অনেকটাই নিশ্চিত করা সম্ভব।

‘এসব ক্রসিংয়ে নেই নিরাপত্তা কর্মী ও সংকেত বাতি। অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে কোনো কোনো সময় ট্রেন হুইসেল না দিয়েই চলে যায়। ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যায়। এতে সুনাম নষ্ট হচ্ছে রেল বিভাগের।’

রেলওয়ে সূত্র জানায়, অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে মানুষের প্রাণহানি নিয়ে রেলের দায়বদ্ধতা নেই। কারণ যানবাহন চলাচলে রেললাইন যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য যানবাহন ও মানুষ পারাপারের জন্য রেল কর্তৃপক্ষ একটি সতর্কবাণী সংবলিত সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছে। অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের বেশিরভাগ সড়ক বিভাগ ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের অধীনে। কিন্তু রেলক্রসিংয়ের নিরাপত্তা রক্ষায় তাদের উদ্যোগ নেই।

মন্তব্য

Beta version