কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যামামলার রায় পড়া শুরু হয়েছে। সোমবার (৩১ জানুয়ারি) দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল আলোচিত এ মামলার রায় পড়ছেন। আদালতে মামলার প্রধান আসামি কক্সবাজারের টেকনাফ মডেল থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ আসামি উপস্থিত রয়েছেন।
এর আগে দুইটার ২টার দিকে আসামিদের কক্সবাজার জেলা দায়রা জজ আদালতের হাজতখানা থেকে এজলাসে নেওয়া হয়।
এ রায় উপলক্ষে ও সব ধরনের নাশকতা এড়াতে কক্সবাজার দায়রা জজ আদালতের চারপাশে গ্রহণ করা হয়েছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কক্সবাজার সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-অপারেশন) সেলিম উদ্দিন আদালতের সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, পুলিশ ও তিনটি সংস্থার সমন্বয়ে আদালতের চারপাশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার হয়েছে।
গত ১২ জানুয়ারি এ মামলার শুনানি শেষ হলে রায়ের জন্য আজকের (৩১ জানুয়ারি) দিনটি নির্ধারণ করেন বিচারক। এদিকে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির প্রত্যাশা করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ও বাদীপক্ষের আইনজীবীরা।
বহুল আলোচিত এই মামলার রায়ের দিকে চেয়ে আছে পুরো দেশবাসী। আদালতের দিকে বিশেষ করে ওসি প্রদীপ ও ইন্সপেক্টর লিয়াকতসহ ১৫ আসামির কী ধরনের শাস্তি হচ্ছে, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে কৌতূহল এবং নানা আলোচনা চলছে।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, ‘আমরা আদালতে সিনহা হত্যার বিষয়টি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের আশা, মামলার প্রধান আসামি বরখাস্ত ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী এবং টেকনাফ মডেল থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ অভিযুক্ত আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। করোনা মহামারির মধ্যেও স্বল্পসময়ে সিনহা হত্যার রায় দেশে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এ রায়ের মধ্য দিয়ে বন্ধ হবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।’
তবে বাদী পক্ষ আসামিদের অপরাধ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে দাবি করে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত বলেন, ‘কোনো ধরনের প্রভাব কিংবা উচ্চ মহলের চাপের বশবর্তী না হয়ে ন্যায়-নীতির মধ্যে থেকে বিচারক আলোচিত এই মামলার রায় দেবেন। যেখানে আবেগ থাকবে না, সঠিক বিচারের নিমিত্তে সত্যের পক্ষে রায়টি হবে।’
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় সরকারি কাজে বাধা প্রদান এবং মাদক আইনে দুটি মামলা করে। এতে আসামি করা হয় সিনহার সঙ্গী সাইদুল ইসলাম সিফাতকে। এছাড়া রামু থানায় মাদক আইনে দায়ের করা আরেকটি মামলায় আসামি করা হয় নিহত সিনহার অপর সঙ্গী শিপ্রা দেবনাথকে। তবে ঘটনার মোড় ঘুরে যায় ৫ আগস্ট যখন নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কক্সবাজার আদালতে মামলা দায়ের করেন। আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তভার পায় র্যাব। চার মাসের বেশি সময় তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র্যাবের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (সিনিয়র এএসপি) খাইরুল ইসলাম ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন। যেখানে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
৩১ ডিসেম্বর আদালত অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করেন এবং একই সঙ্গে পুলিশের দায়ের করা তিনটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলা থেকে সাইদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথকে অব্যাহতি দেন। এরপর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহর আদালত থেকে মামলাটির কার্যক্রম জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেনের আদালতে বদলি করা হয়। বর্তমানে মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ওসি প্রদীপসহ ১৫ জনই কক্সবাজার জেলা কারাগারে রয়েছেন। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন ১২ জন।
৮৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ৬৫ জন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এতে করে সব আসামির অপরাধ প্রমাণ করতে পেরেছেন বলে দাবি করেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট ফরিদ।
গত ২৪ জুন মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি কনস্টেবল সাগর দেবের আদালতে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আলোচিত এই মামলার ১৫ আসামির সবাই আইনের আওতায় আসে। মামলায় গ্রেফতার হওয়া ১৫ আসামি হলেন- বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন পরিদর্শক ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী, টেকনাফ মডেল থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত, বরখাস্ত সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, বরখাস্ত কনস্টেবল ছাফানুল করিম, বরখাস্ত কনস্টেবল কামাল হোসাইন আজাদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন, কনস্টেবল রুবেল শর্মা ও কনস্টেবল সাগর দেব, বরখাস্ত এপিবিএনের উপপরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান আলী, বরখাস্ত কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, রাজীব হোসেন, টেকনাফ থানায় পুলিশের দায়ের করা মামলার সাক্ষী বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আয়াজ ও নেজাম উদ্দিন।
মন্তব্য