দরিদ্র ঘরের সন্তান নিপুন বিশ্বাস। বাড়ি নীলফামারী সদর উপজেলা লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়নে। অদম্য মেধাবী নিপুন এবার যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তবে দীর্ঘ সড়কপথ পাড়ি দিয়ে নীলফামারি থেকে যশোরে যথাসময়ে পৌঁছাতে না পারায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া হয়নি তার।
মূলত দরিদ্র নিপুনের বাবা নাপিতের কাজ করে বহু কষ্টে সংসার চালান। তাদের ঘরে নেই কোনো স্মার্টফোন। নেই নেট কানেকশনও। নিপুনের পক্ষে বারবার ওয়েবসাইটে ঢুকে জানা সম্ভব হচ্ছিল না তিনি ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন নাকি হন নাই। যদিও নিয়ম ছিল কর্তৃপক্ষ মেসেজ দিয়ে জানাবে। কিন্তু তার মোবাইলে সেই মেসেজও আসে নাই।
তবে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণের বিষয়টি যখন অন্যের মাধ্যমে জানতে পারলেন, তখন সময় বেশি বাকি নেই। তড়িঘড়ি করে টাকা ধার নিয়ে ১৫ হাজার টাকা চুক্তিতে মাইক্রোবাস ঠিক করেন। পথে দেরি হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই মারফত ডিনকে ফোন করে নিপুন জানান- তিনি পথে আছেন।
কিন্তু ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে বলা ছিল- ৩১ জানুয়ারি সকাল ১০-১১টার মধ্যে শিক্ষার্থীকে উপস্থিত থাকতে হবে। তবে নীলফামারী থেকে নিপুন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছান ১২টা ৮ মিনিটে। দেরি হওয়ার কারণে নিপুনের ভর্তি নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। মুহূর্তেই ভেঙে যায় নিপুনের সব স্বপ্ন।
বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচনা সৃষ্টি হয়। এ ব্যাপারে দৃষ্টি এড়ায়নি নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর। এ নিয়ে ভেরিফায়েড ফেসবুকে দীর্ঘ একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন তিনি। ফারুকী লেখেন-‘যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় টিকেও ভর্তি হতে পারছেন না নিপুন বিশ্বাস। নিপুন দরিদ্র ঘরের সন্তান। তার বাবা নাপিতের কাজ করে বহু কষ্টে সংসার চালান। ফলে নিপুনের কোনো স্মার্টফোন নাই। স্মার্টফোন এবং নেট কানেকশন না থাকাতে তার পক্ষে বারবার ওয়েবসাইটে ঢুকে জানা সম্ভব হচ্ছিল না সে টিকেছে নাকি টিকে নাই। নিয়ম ছিল কর্তৃপক্ষ মেসেজ দিয়ে জানাবে। কিন্তু তার মোবাইলে মেসেজও আসে নাই। যে দিন ভর্তি হওয়ার শেষ তারিখ ছিল, তার আগের দিন সে কারো একজনের কাছে জানতে পারে সে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। তারপরই দ্রুত টাকা জোগাড় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা হয়। যেহেতু ওটা ছিলো শেষ দিন, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই মারফত ফোন করে ডিনকে জানায় যে সে পথে আছে। যাই হোক, তার পৌঁছতে পৌঁছতে দেরি হয়ে যায় এবং বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ভর্তি করতে অপারগতা জানায়।’
বেশ কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, ‘এই পর্যন্ত পড়ে চোখ বন্ধ করে নিপুনকে দেখতে পাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকের বাইরে জীর্ণ স্যান্ডেল পায়ে নিপুন দাঁড়িয়ে। তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। তার গলা আটকে আটকে আসছে। সে বুঝতে পারছে না সে কাকে দোষ দেবে? তার মোবাইল না থাকাকে? মেসেজ না আসাকে? পথে দেরী হওয়াকে? নাকি তার দরিদ্র পিতাকে?’
বিশ্ববিদ্যালয় কবে থেকে এতটা নিষ্ঠুর হয়ে উঠল- সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ফারুকীর চিন্তায়। তিনি লেখেন, ‘আচ্ছা কবে থেকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এতো নিষ্ঠুর হয়ে উঠল? কবে থেকে শিক্ষকেরা হয়ে উঠল এরকম বেরহম? আমি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি নাই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষকের নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছি। আমি তো দেখেছি তারা ছাত্রদের বিপদে আপদে কীভাবে পাশে দাঁড়ান। আইনকে ছাত্রের পথের কাঁটা না করে, আইনের হাত মচকে দিয়ে ছাত্রের জন্য রাস্তা বানান। সেই সব শিক্ষকদের দিন কি তবে শেষ? তবে আমরা কাদের শিক্ষক বানাচ্ছি? কী শিক্ষা দেবেন তারা আমাদের?’
বিশ্ববিদ্যালয়েরও হৃদয় থাকতে হয় বলে মনে করেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি আরও লেখেন, ‘যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এখনও সময় শেষ হয়ে যায় নাই প্রমাণ করার যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা হৃদয়ও থাকা লাগে।’
মন্তব্য