-->

অপরাধে জড়াচ্ছেন জনপ্রতিনিধিরা

জহির রায়হান, বরিশাল ব্যুরো
অপরাধে জড়াচ্ছেন জনপ্রতিনিধিরা

কথায় আছে জনগণের সেবক হচ্ছে জনপ্রতিনিধিরা। জনগণের দুঃখ-দুর্দশা মোচন আর খেদমত করাসহ সরকারি সহায়তা বিতরণ ও জানমালের নিরাপত্তার পাশাপাশি সার্বিক কল্যাণের খোঁজখবর রাখাই হচ্ছে জনপ্রতিনিধিদের প্রধান কাজ।

কিন্তু ইদানীং বরিশাল বিভাগ জুড়ে দেখা গেছে- খুন, ধর্ষণ, জমি দখল, আত্মসাৎ, মারধর, চুরি-লুটপাট ও বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকাণ্ডসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন জনপ্রতিনিধিরা।

এছাড়াও অনেক জনপ্রতিনিধি প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের অত্যাচার, দমন-নিপীড়ন সহ্য করছেন অসহায় জনগণ। অবশ্য অপরাধ অনুযায়ী আইনের আওতায়ও আসছেন এসব জনপ্রতিনিধিরা। সাজাও ভোগ করছেন অনেকে। কেউ আবার ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে কলকাঠি নাড়ছেন।

জনগণ বলছেন, জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস কথাটি এখন খাতা-কলমে। বাস্তবে তার উল্টো। জনগণের ওপর ভর করে জনপ্রতিনিধি হলেও এখন জনগণের মূল্যায়ন নেই। রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকা পালন করছেন জনপ্রতিনিধিরা। এখন থেকে জনপ্রতিনিধিদের প্রতারণা, দখল, আত্মাসৎ সহ নানা অপরাধ প্রতিহত করা না গেলে ভবিষ্যতে আরও ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

স্থানীয় ভুক্তভোগী পরিবার, থানা পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, জানুয়ারি মাসে কয়েকটি হিন্দু সম্প্রদায় পরিবারের বসতভিটা, জমিদখল ও জমি দখলের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে বরিশাল-২ আসনের (উজিরপুর-বানারীপাড়া) সংসদ সদস্য শাহে আলম তালুকদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে ২৫ জানুয়ারি মঙ্গলবার বিকেলে বরিশাল প্রেসক্লাবে এমপির বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলনও করেছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। এর আগে ২ জানুয়ারি বিকেলে এমপির উপস্থিতিতে বানারীপাড়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য জমি দখলের অভিযোগ করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরের স্বজনরা।

অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এমপি শাহে আলম। তার বিরুদ্ধে একটি কুচক্রীমহল জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

গত ১৪ জানুয়ারি শুক্রবার দুপুরে বিয়ের প্রলোভনে একাধিকবার ধর্ষণের অভিযোগ এনে বরিশাল সিটির ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আজাদ হোসেন মোল্লা কালামের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করেন ভুক্তভোগী এক নারী। মামলার দিন সন্ধ্যায় কালাম মোল্লাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরেরদিন শনিবার দুপুরে বরিশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাকে হাজির করলে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক পলি আফরোজ।

কারাগারে পাঠানোর ছবি আদালত চত্বরে তুলতে গেলে কাউন্সিলর ও সহযোগীরা গণমাধ্যমকর্মীদের হুমকি দেন। জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া নিলাম বিক্রি, দলিল ও পর্চা তৈরি করে একই এলাকার বাসিন্দা নরেন্দ্র নাথ পালের ওয়ারিশ সূত্রে পাওয়া ৬০২ শতাংশ জমি দখলের অভিযোগে মামলা করা হয়। গত ২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ওই মামলায় বাকেরগঞ্জের দাড়িয়াল ইউপির চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম হাওলাদার, তার ভাই আ. রশিদ হাওলাদার, আবুল হোসেন হাওলাদার, তহিদুল ইসলাম হাওলাদার এবং বোন শাহানুর বেগমকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।

৩০ জানুয়ারি রোববার বিকেল পৌনে ৪টায় বরিশাল থেকে ঢাকাগামী নভোএয়ার বিমানের যাত্রী ছিলেন ঝালকাঠি সদর উপজেলার কেওড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু সাঈদ খান। বিমানবন্দরের সর্বশেষ চেকিং গেট অতিক্রমকালে তল্লাশিতে আবু সাঈদ খানের কাছে ইয়াবা ট্যাবলেটের খোঁজ মিলে। এরপর সাথে সাথে ইয়াবা ট্যাবলেট গিলে ফেলেন তিনি। এ ঘটনায় আদালতের মাধ্যমে চেয়ারম্যান আবু সাঈদ খানকে জেলহাজতে পাঠানো হয় বলে নিশ্চিত করেছেন বিমানবন্দর ব্যবস্থাপক মো. আব্দুর রহিম তালুকদার।২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ঝালকাঠিতে দিনমজুর মিরাজ শেখ (৩৫) হত্যা মামলার আসামি সদর উপজেলার কেওড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নজরুল ইসলামসহ ৯ জনকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। এরআগে মামলার প্রধান আসামি ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নজরুল ইসলামসহ ৯ জন উচ্চ আদালতের জামিনে ছিলেন।

একই তারিখে বরগুনা সদর উপজেলার ৫ নম্বর আয়লা পাতাকাটা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেনের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন দ্রুত বিচার আদালতের বিচারক মো. নাহিদ হোসেন। তিনি দীর্ঘদিন পলাতক ছিলেন। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা ছিল। মূলত গত বছরের ১২ জুন দুপুরের দিকে ওই ইউনিয়নের পূর্ব কেওড়াবুনিয়া গ্রামে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এম মজিবুল হক কিসলুর সমর্থকদের ওপর হামলা করে ১৩টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর, একটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ ও মজনু নামে একজনকে কুপিয়ে জখম করা হয়। নৌকার প্রার্থী বাদী হয়ে পরদিন ১৩ জুন বরগুনা থানায় ১৩২ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন।

এছাড়াও ২০২১ সালে ৬ সেপ্টেম্বর পটুয়াখালীর ছোট বিঘাই ইউপির চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি আলতাফ হাওলাদারসহ ২২ জনকে জেলহাজতে পাঠিয়েছেন দ্রুতবিচার আদালতের বিজ্ঞ বিচারক আমিরুল ইসলাম।মামলা সূত্রে জানা গেছে, ছোট বিঘাই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলতাফ হাওলাদার ২০২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭টায় ছোটবিঘাই ইউনিয়নের মাটিভাংগা গ্রামে শহীদ গাজীর গাজী ব্রিকসে পূর্বের পাওনা টাকা না দিয়ে পুনরায় ৫ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে হামলা চালায়।

একই সালের ২৬ আগস্ট বৃহস্পতিবার দুপুরে ছিনতাই মামলায় বরিশাল সদর উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিটন মোল্লাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন বরিশাল অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মারুফ আহম্মেদ। তবে বর্তমানে লিটন মোল্লা জামিনে আছেন।ওই বছরের ২৩ জুলাই বিমানবন্দর থানায় লিটন মোল্লা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে চাঁদার দাবিতে মারধর করে প্রায় আড়াই লাখ টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগ এনে মামলা করেন গোল্ডেন লাইন পরিবহনের বরিশালের নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালের কাউন্টার ব্যবস্থাপক শহিদুল ইসলাম।

ভুক্তভোগী অনুপ কুমার গুহ অভিযোগ করে বলেন, গত ২ জানুয়ারি বিকেল সাড়ে চারটার দিকে এমপি শাহে আলম লোকজন নিয়ে আমাদের জমির টিনের বেড়া ভেঙে ফেলেন। এরপর দুই পাশে বালিকা বিদ্যালয়ের দেয়াল ভেঙে বিদ্যালয়ের মধ্যে জমি নিয়ে টিনের বেড়া দিয়ে আটকে দখলে নিয়ে নেন।’

ভুক্তভোগী রতন ঘরামী ও সুমন সিকদার জানান, তারা প্রায় ২০০ বছর ধরে পশ্চিম তেতলা গ্রামে পূর্বপুরুষের ভিটেবাড়িতে বসবাস করছেন। বসতবাড়িসহ ১০ কাঠা জমি আছে। এই জমি এমপি শাহে আলম লিখে নিতে চান। এ অবস্থায় তারা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। কখন কি হয় জানি না।

স্থানীয় বিশ্লেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আনিসুর রহমান খান স্বপন বলেন, জনগণের জন্য নয়, জনপ্রতিনিধিরা মূলত দুর্নীতির প্রতিনিধি। জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হলেই তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমনকি ভোটের সময় দেয়া প্রতিশ্রুতিও তারা ভুলে যায়। এসব জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে জনগণদের সচেতন হয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে হবে।এখন থেকে জনপ্রতিনিধিদের অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর না হলে দিন দিন তাদের অপরাধের মাত্রা আরও বাড়বে বলে আশংকা করছেন এই বিশ্লেষক।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ডক্টর তারেক মাহমুদ আবির দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, জনপ্রতিনিধিদের সাথে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীসহ সর্বস্তরের মানুষের সম্পর্ক রয়েছে। ফলে তাদের ওপর আইন শাসনের প্রভাব কম। এতে করে জনপ্রতিনিধিরা অপরাধ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। পাশাপাশি জনগণের সাথে বিচ্যুতি আচরণ করছে। আবার যাদের সাথে অপরাধ করে তারা জনপ্রতিনিধিদের ভয়ে থানায় অভিযোগও দিতে পারে না। ফলে জনপ্রতিনিধিরা আরও বেশি করে অপরাধ করেন।তিনি আরও বলেন, যথার্থ পারিবারিক, ধর্মীয়, নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় জনপ্রতিনিধিরা জনগণের সাথে প্রতারণা, অন্যায়ভাবে অপরাধ চাপিয়ে দেয়া, জমি দখল সহ নানা ভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন।

এর থেকে প্রতিকার হিসেবে এই চেয়ারম্যান আরও বলেন, আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহি নির্বাচন উপহার দেয়া। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করতে জনগণকে প্রাধান্য দেয়া। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ এবং শতভাগ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। তাহলে জনগণের সাথে জনপ্রতিনিধিদের ভালো বোঝাপড়া তৈরি হবে।

মন্তব্য

Beta version