-->
শিরোনাম

ইউরোপের স্বপ্ন ভেজে স্বজনের কান্নায়

কামরুল ইসলাম মাহি, সিলেট
ইউরোপের স্বপ্ন ভেজে স্বজনের কান্নায়
ইতালি যাওয়ার পথে ভ‚মধ্যসাগরে মারা যাওয়া সাজ্জাদের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের মামুদপুর গ্রামে স্বজনদের কান্না। ছবি ভোরের আকাশ

সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার পূর্ব লাউজারী গ্রামের তরুণ আব্দুল্লাহ আল মামুন। শান্ত স্বভাবের এই তরুণ চেয়েছিলেন উন্নত জীবন। আর ইউরোপের কথা শুনলেই তার চোখে ভেসে ওঠে রঙিন সব স্বপ্ন আর মোহবন্ধনের হাতছানি।

পরিবারের কাছে বায়না ধরেন ইউরোপের দেশ ইতালিতে যাবেন। প্রথমে পরিবার রাজি হয়নি। কিন্তু ছেলের উন্নতজীবন গড়ার স্বপ্নে একসময় রাজি হন বাবা। দালাল ধরে লিবিয়া হয়ে ইতালি যেতে দেশ ছাড়েন মামুন। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তির নির্মম খেলা বড়ই আজব! মুহূর্তেই পরিবার আর স্বজনদের সব স্বপ্ন যেন কান্নার জলে ভেসে গেল। মামুনের পরিবার জানিয়েছে, সে লিবিয়ায় নিখোঁজ রয়েছে। বেঁচে আছে না নেই এই খবরটাও পাচ্ছে না তারা।

মামুনের বাবা আতিকুর রহমান জানান, তার ছেলে দালালের মাধ্যমে ইতালিতে যেতে চেয়েছিল। বর্তমানে সে লিবিয়ায় নিখোঁজ রয়েছে। দালালকেও এখন ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ফোন বন্ধ রয়েছে।

তিনি জানান, ইতালি যাওয়ার জন্য মামুন চার মাস ধরে লিবিয়ায় অবস্থান করছিল। এখন তার কোনো খোঁজ নেই।

তবে তিনি ধারণা করছেন, হয়তো পুলিশের হাতে ধরা পড়ে লিবিয়ার কোনো জেলে বন্দি আছে মামুন। সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া এখন আর কোনো পথ খোলা নেই। শুধু মামুন নয়, সিলেটজুড়ে এ রকম অসংখ্য মামুন রয়েছেন যারা স্বপ্নের ইউরোপ গিয়ে কেউবা নিখোঁজ হচ্ছেন আর কেউবা সাগরে ডুবে প্রাণ হারাচ্ছেন।

প্রবাসী অধ্যুষিত জেলা সিলেট। ইউরোপ প্রবাসী নেই এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া যাবে না সিলেট বিভাগে। তাই এ অঞ্চলের তরুণরাও ইউরোপ যাত্রার স্বপ্নে বিভোর। যেকোনোভাবে তাদের ইউরোপের কোনো দেশে যেতে হবে- এ যেন তাদের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে দালালদের খপ্পড়ে পড়ে প্রাণপ্রদীপ নেভাচ্ছেন অনেকে। বিভিন্ন দেশে তাদের আটকে মুক্তিপণ হিসেবে দেশের স্বজনদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দালালরা।

গত ২৫ জানুয়ারি ইতালির অ্যাগ্রিজেনটো শহরের প্রসিকিউটর লুইগি প্যাট্রোনাজ্জিওর এক বিবৃতিতে জানান, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লিবিয়া থেকে ইতালির ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ ল্যাম্পেদুসা যাওয়ার পথে সাত বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। এই সাত বাংলাদেশির মধ্যে একজন সাজ্জাদুর রহমান। তিনি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালি ইউনিয়নের ফেকুল মাহমুদপুর গ্রামের নুরুল আমিন তালুকদারের ছেলে।

কৃষক বাবার এই ছেলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। বিদেশ যাবার ইচ্ছে ছিল তার ছোটবেলা থেকেই। কর্মঠ ছেলেটিকে বিদেশে পাঠানোর জন্য জমিজমা বন্ধক দিয়ে লিবিয়া পাঠান বাবা নুরুল আমিন। সবশেষ তার মৃত্যুর খবর পায় পরিবার। এতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে পরিবারটি।

সম্প্রতি গ্রিস-তুরস্ক সীমান্তের অভিবাসীপ্রত্যাশী ১২ জনের মধ্যে দুজনের বাড়ি সিলেটের সুনামগঞ্জে।

এর আগে চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি সিলেটের ২৪ তরুণ ইউরোপ গিয়ে লিবিয়ায় নিখোঁজ রয়েছেন বলে সংবাদ সম্মেলন করে জানান নিখোঁজদের স্বজনরা। নিখোঁজ ওই ২৪ যুবকের সন্ধান ও মানবপাচারকারী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তোলেন তারা।

লিবিয়ায় নিখোঁজ থাকা তরুণরা হলেন- পূর্ব লাউজারী গ্রামের তানহারুল ইসলাম, একই গ্রামের আব্দুল্লাহ আল মামুন, হোসেন আহমদ, আব্দুল্লাহ আল জুনেদ, আরিফ আহমদ দুলাল, খশিরবন্দ (হাতিটিলা) গ্রামের রাজু আহমদ, একই গ্রামের এনামুল হক, খশির কোনাপাড়া গ্রামের কামরুজ্জামান রাহাত, ঘুঙ্গাদিয়া নয়াগাঁও গ্রামের আব্দুল আজিজ, একই গ্রামের আহমদ অজিত, গড়রবন্দ গ্রামের আব্দুল করিম। এ ছাড়া বিয়ানীবাজারের আমিনুর রহমান নামে এক তরুণ লিবিয়ায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন।

নিখোঁজদের স্বজনরা জানিয়েছেন, ওই সিন্ডিকেটটি ইতালিতে পাঠানোর নাম করে লিবিয়ায় সিলেটের ২৫ তরুণকে জিম্মি করে রেখেছিল। এর মধ্যে একজন মারা গেছেন সে দেশের পুলিশের গুলিতে। আর বাকি ২৪ জন কোথায় আছে তারও খোঁজ মিলছে না সাত-আট মাস ধরে।

স্থানীয় সূত্রমতে, বর্তমানে সিলেটের হাজারো তরুণ লিবিয়ায় রয়েছে। তাদের অনেকেই রয়েছে জিম্মি, কেউ কেউ কারাগারে। আবার কেউবা সাগরে। লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার অন্যতম রুট লিবিয়া। সেখানে বেলুনের নৌকায় অভিবাসন প্রত্যাশীদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর ভাসতে ভাসতে গিয়ে কিনারা হয় ইতালিতে।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, দালালচক্র সিলেটের প্রবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে নিজস্ব এজেন্ট নিয়োগ দেয়। অবস্থাসম্পন্ন পরিবারগুলোতে গিয়ে এজেন্টরা শুভাকাক্সক্ষী সেজে তাদের পরিবারের তরুণ সদস্যদের ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করে। পরিবার রাজি হলে তাদের দালালের ঠিকানা ধরিয়ে দেয় এজেন্ট। এরপর দালালচক্রের সদস্যদের সঙ্গে চলে ইউরোপ যেতে আগ্রহীদের চুক্তি।লিবিয়ায় নিখোঁজ একজন তরুণের পরিবার জানায়, দালালের সঙ্গে চুক্তি ছিল গন্তব্যে পৌঁছনোর আগে কোথাও পুলিশের হাতে আটক হলে দালাল তার নিজ দায়িত্বে ও খরচে সে মুক্ত করবে। কিন্তু লিবিয়ায় যাওয়ার পর দালালরা চুক্তির কোনো কিছুই মানছে না। তারা নানা অজুহাতে শুধু টাকাই নিয়েছে।

সিলেট জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) লুৎফুর রহমান দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, ‘মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তা ছাড়া কিছুদিন আগে মানবপাচার মালায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছি। ওই মামলা নিয়ে সিআইডি কাজ করছে।’

সিলেট জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (প্রবাসী কল্যাণ শাখা) মাসুমা আক্তার কণা এ বিষয়ে বিস্তারিত বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, ‘এই অঞ্চলের প্রবাসীদের সমস্যা নিয়ে সিলেট জেলা প্রশাসন সবসময় আন্তরিক হয়ে কাজ করে। মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে।’

মন্তব্য

Beta version