-->
শিরোনাম

বাবার জন্য তৈরি প্যান্ডেলেই শ্রাদ্ধ হবে ৫ ছেলের

আহসান সুমন, কক্সবাজার
বাবার জন্য তৈরি প্যান্ডেলেই শ্রাদ্ধ হবে ৫ ছেলের

বাবার শ্রাদ্ধের জন্য তৈরি করা বাড়ির উঠানের সেই প্যান্ডেলটি এখনো রয়ে গেছে। অতিথি নিমন্ত্রণ, খাবারের জন্য কেনাকাটাও প্রায় শেষ করেছিলেন সন্তানেরা। কিন্তু সেই শ্রাদ্ধের আগেই ঘটে গেল ভয়াবহ দুর্ঘটনা। কে জানত পরলোকগমন করা পিতার সঙ্গে যোগ হবে আরো পাঁচ ছেলের শ্রাদ্ধ। এমন কঠিন বাস্তবতাকে যেন মেনেই নিতে পারছেন না সুরেশ সুশীলের পরিবার। সাত ছেলের মধ্যে পাঁচজনকে হারিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন সুরেশের স্ত্রী মানু বালা সুশীল। স্বামী-সন্তানের শোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি। পাশে প্রতিবেশী ছাড়া সান্ত্বনা দেবারও কেউ নেই। কারণ বাকি তিন সন্তানের মধ্যে দুই ছেলে এবং একমাত্র মেয়েটিও হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।

এক নিমিষেই নিজের পরিবার তছনছ হওয়ার শোকে স্তব্ধ মানু বালা কান্না করতে করতে যেন তার চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে। এতটাই শোকাহত যে তিনি কান্নাও করতে পারছেন না। এর আগে পিতার শ্রাদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা বাড়ির উঠানের সেই প্যান্ডেলের নিচেই পাঁচ ভাইয়ের মরদেহ রাখা হয়েছিল। সন্ধ্যায় একই শ্মশানে সৎকার করা হয় কক্সবাজারের চকরিয়া মালুমঘাটে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত পাঁচ ভাইয়ের। মর্মান্তিক এ ঘটনায় স্থানীয় থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারাও শোকে বিহ্বল।

নিহত পাঁচ ভাই হলেন- মৃত সুরেশ চন্দ্র সুশীলের ছেলে অনুপম সুশীল (৪৮), নিরুপম সুশীল (৪৫), দীপক সুশীল (৪০), চম্পক সুশীল (৩৮) ও স্মরণ সুশীল (৪৬)। স্বামী হারানোর শোকে আর্তনাদ করছেন নিহত অনুপম সুশীলের স্ত্রী পপি। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, এখন আমরা কী নিয়ে বাঁচব? হাসিখুশিতে ভরপুর সাজানো সংসার, সুন্দর-সুখী পরিবারটি মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল। ধ্বংস হয়ে গেল বেঁচে থাকার স্বপ্ন! একইভাবে বিলাপ করে কাঁদছেন নিহত চারজনের স্ত্রী। ছোট ছেলে-মেয়েরাও কান্নাকাটি করছেন। তাদের আর্তনাদে যেন আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।

মঙ্গলবার ভোরে কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাট খ্রিষ্টান হাসপাতালসংলগ্ন এলাকায় কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে কক্সবাজারমুখী একটি মিনি ট্রাকের চাপায় ঘটনাস্থলেই চার ভাই মারা যান। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর আরো এক ভাইয়ের মৃত্যু হয়। সুরেশ সুশীলের বাড়িতে মানুষের ভিড় চোখে পড়ছে। শুধু নিকটাত্মীয় কিংবা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নন, মুসলিম সম্প্রদায়েরও অনেকেই আসছেন সমবেদনা জানাতে। এমন হৃদয়বিদারক ঘটনায় প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন যেন সবাই হতবিহ্বল।

চকরিয়া সংগীত নিকেতনের অধ্যক্ষ ও স্থানীয় বাসিন্দা সন্তোষ কুমার সুশীল বলেন, প্রয়াত সুরেশ চন্দ্র সুশীল ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী। ১০ দিন আগে গত ২৮ জানুয়ারি বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি মারা যান। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অংশ হিসেবে ক্ষৌরকর্ম ছিল ৮ ফেব্রুয়ারি। এই কর্ম পালন করার জন্য তারা সাত ভাই ও এক বোন ভোরে মহাসড়কের পূর্ব পাশের মন্দিরে গিয়েছিলেন। এ কাজ শেষে বাড়ি ফেরার জন্য মহাসড়কের পাশে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। এরপর ঘরে পৌঁছে বাকি কর্ম সেরে তারা বাবার শ্মশানে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর আগেই ভোরে কক্সবাজারমুখী একটি মিনি ট্রাক মূল সড়ক থেকে নেমে গিয়ে তাদের চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই চার ভাইয়ের মৃত্যু হয়। ওই দিন বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরেক ভাই স্মরণ।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, এ সময় অল্পের জন্য প্রয়াত সুরেশ চন্দ্র সুশীলের ছেলে প্লাবন (১৯) ও মেয়ে মুন্নী (২৮) প্রাণে রক্ষা পান। প্লাবন এবার ডুলাহাজারা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ঘটনার পর থেকে সেও অনেকটা পাগলপ্রায়। স্থানীয় ডুলাহাজারা ইউপি চেয়ারম্যান হাসানুল ইসলাম আদর বলেন, ঘটনাটি খুবই মর্মস্পর্শী। আসলে এই মুহূর্তে তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছি। একটি দুর্ঘটনায় অনেকগুলো জীবন তছনছ হয়ে গেল। চকরিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ ওসমান গণি বলেন, এ দুর্ঘটনায় আমরা সবকিছু মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেছি। পরিবারের সদস্যদের ইচ্ছায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ সৎকারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের চাপা দেওয়া গাড়ি ও এর চালককে আটকে অভিযান চলছে।

চকরিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর এখনো শ্রাদ্ধ হয়নি। এর মধ্যে একসঙ্গে চলে গেল পাঁচ সন্তান। এটা সৃষ্টিকর্তার একটা কঠিন পরীক্ষা। পরিবারটি এ শোক কীভাবে সইবে বুঝতে পারছি না। বিশেষ করে বৃদ্ধ মায়ের জন্য চিন্তা হচ্ছে খুব বেশি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার কথা জানিয়ে ইউএনও বলেন, এ পরিবারের জন্য এটি অপূরণীয় ক্ষতি। সৃষ্টিকর্তা যেন পরিবারের বাকি সদস্যদের এ শোক সইবার শক্তি দেন, সেই প্রার্থনা করি সবসময়।

মন্তব্য

Beta version