শুধু রাজশাহী জেলা নয়, গোটা উত্তরাঞ্চলের চিকিৎসাসেবার ‘শেষ’ আশ্রয়স্থল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল। অতীতে এই হাসপাতালে শুরু থেকে সব ওয়ার্ডে ময়লা, আবর্জনা ও দুর্গন্ধ ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। কিন্তু বর্তমানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সুদক্ষ কার্যক্রমে নতুন রূপে ফিরেছে সৌন্দর্য। প্রধান দুই প্রবেশদারসহ ওয়ার্ডগুলোতে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ফিরেছে।
অন্যদিকে চিকিৎসাসেবার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন চিকিৎসার সরঞ্জাম ও পরীক্ষার কার্যক্রম। ফলে সেবা নিতে আসা রোগীরা বাইরে অতিরিক্ত টাকা খরচের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছেন। রামেক হাসপাতাল সরেজমিন পরিদর্শন করে কর্তৃপক্ষ ও সেবা নিতে আসা রোগীদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রের দেখা মিলেছে। রামেক হাসপাতালে প্রবেশের জন্য একটি পথ বাইরে বের হওয়ার জন্য আলাদা আলাদা রাস্তা করা হয়েছে। একইসঙ্গে আলাদাভাবে তৈরি করা হয়েছে হেঁটে হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার ব্যবস্থা। আবার প্রবেশদ্বারের পাশে যুগ যুগ ধরে জঙ্গল ও ময়লা-আবর্জনার স্তূপ হয়ে পড়ে থাকা বিস্তীর্ণ এলাকা পরিষ্কার করে লাগানো হয়েছে ফুলের গাছ।
রামেকে প্রবেশের শুরুতেই করা হয়েছে একটি মোটরসাইকেল গ্যারেজ। অন্যদিকে পূর্বপাশে ছাউনি দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাস রাখার জায়গা।দেখা গেছে, বাঁশি ও লাঠি নিয়ে রামেকের ভেতরে বিভিন্ন যানবাহন নিরসনের দৃশ্যও। এতে রামেকে জটলা ধরে অটোরিকশা কিংবা সিএনজি দাঁড়িয়ে থাকছে না। ফলে নির্বিঘ্নে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্সে রোগী আসা-যাওয়া করছে মুহূর্তের মধ্যেই।
আবার রামেকের ভেতর ও ঠিক বাইরের দিকেই দাঁড়িয়ে থাকত মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট। একে তো স্বজন হারানোর বেদনা, তারপর আবার স্বজনের মরদেহ পরিবহনের জন্য চেয়ে বসত পাঁচ থেকে ১০ গুণ বেশি ভাড়া। বর্তমানে সেই চিত্রও পাল্টেছে।
এক্ষেত্রে রামেক কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, বিভিন্ন ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত ডাস্টবিনের ব্যবস্থা আমরাই করতে পারিনি। তাই অনেক সময় বাধ্য হয়ে রোগীর স্বজনরা ময়লা-আবর্জনা ফেলার জায়গা না পেয়ে বাইরে ফেলেন। আগামীতে পরিবেশ আরো সুন্দর পরিচ্ছন্ন করার জন্য ডাস্টবিনসহ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন রামেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী।নগরীর নওদাপাড়ার বাসিন্দা সোহেল। রামেকে ভর্তি রয়েছে বাবা। হাসপাতালের পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসেবার মান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগের চেয়ে পরিবেশটা অনেক সুন্দর হয়েছে। আবার ডাক্তাররাও সময় দিয়ে রোগী দেখছেন। চুরি-চামারি আটকাতে আইডি কার্ড ছাড়া ঢুকতে ও বের হতে দেয় না। এটা অনেক ভালো হয়েছে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার বাসিন্দা মো. কুতুবউদ্দিন। ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন তার মা। তিনি বলেন, ‘এটা সত্যিই যে সেবার মান আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। রামেকে টেস্টও হচ্ছে অনেক। পরিবেশটা দারুণ হয়েছে।’
এদিকে পার্কিং স্লটে দায়িত্বে ছিলেন আশিক নামে এক আনসার সদস্য। রামেকে কাজ করছেন ছয় মাস ধরে।তিনি বলেন, ছ’মাসের মধ্যেই রামেকে আমি অনেক পরিবর্তন দেখেছি। বাইরে নোংরা পরিবেশের পরিবর্তন হয়ে ফুলের বাগান হয়েছে, হয়েছে স্টাফদের জন্য পার্কিং স্লট। আবার ইমারজেন্সির গেটের দিকে পানি জমে থাকত, সেটিও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে আর জমে না। সবমিলিয়ে রামেকের পরিবেশ অনেক উন্নত হয়েছে।
রামেক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এ হাসপাতালে রয়েছে মোট ১২০০ শয্যা। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার রোগীর আনাগোনা রামেকে। তবে এ পরিমাণটি গরমের সময় বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় তিন থেকে চার হাজারে। ওয়ার্ড রয়েছে ৫৭টি। হাসপাতালটিতে চিকিৎসক পদ রয়েছে ২৩৩টি যার মধ্যে ৩০টি পদ শূন্য। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির মোট ৯১১ পদের মধ্যে ১৪৬টি শূন্য আছে। আগের ৫৫০ শয্যার জনবল দিয়েই ১২০০ শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতালটির কার্যক্রম চলছে। এতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
বর্তমানে রামেক হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী। তিনি ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর রামেকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। যোগদানের আগে ঢাকা সিএমএইচ হাসপাতালের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। রামেকে আসার পর প্রথমেই নজর দেন নোংরা পরিবেশ দূর করার দিকে।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসেই দেখি রামেকের বিভিন্ন জায়গায় অনেক নোংরা ও দুর্গন্ধ। যেটা আমরা অল্প চেষ্টা করলেই দূর করতে পারি। ড্রেনগুলো খারাপ ছিল, ম্যানপাওয়ারও ছিল কম। প্রথমদিকে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছিলাম। তারপর পারসোনালি এখানকার এমপ্লোয়ারদের মটিভেট করে চ্যালেঞ্জ হিসেবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশে নিয়ে আসি।
তিনি জানান, এখানে কোনো বাগান বা মালির খাত নেই। তারপরও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, রাস্তার ইন-এক্সিট, যানজট ও সিন্ডিকেট দূরীকরণসহ ডানে-বামে ম্যানেজ করে বাগান করেছি। যাতে মানুষ রামেকে ঢুকতেই তার মনটা পরিবর্তন হয়ে য়ায়। গেটের ভেতরে বাইরে সেবা ও সচেতনতার জন্য সাইনবোর্ড ব্যবহার করা হচ্ছে। রোগীর তুলনায় জনবল কম। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ডিজি হেলথের মাধ্যমে ১০৬ জন লোক আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নেওয়ার আহ্বান করেছি।
তিনি বলেন, আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শয্যা সমস্যা। হাসপাতালে ১০ তলার ফাউন্ডেশন হলেও চার তলা পর্যন্ত হয়েছে। সেক্ষেত্রে যদি রোগীর শয্যা বাড়ানো যেত তাহলে রোগীর সেবার মান আরো বাড়ানো সম্ভব ছিল। কারণ সবাই ফোন করে একটা বেড চাই।
পরিচালক বলেন, ‘বর্তমানে রামেকে প্রত্যেকটি চিকিৎসক থেকে শুরু করে নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারী, পরিচ্ছন্নকর্মী ও আনসারদের মটিভেট করা হচ্ছে। আনসারদের প্রাতিষ্ঠানিক তেমন ট্রেনিং নেই। তাদের মাঝে মধ্যেই ব্রিফ করা হয় যেন তারা তাদের দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করতে পারে। এসবের ফলও বেশ মিলেছে।
চিকিৎসক-নার্সেরা সেবা দিচ্ছেন, পরিচ্ছন্নকর্মীরা তাদের কাজ করছেন আবার আনসাররা মানুষকে মাঝে মাঝে সহায়তায় দৌড়ে যাচ্ছেন। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে হাজিরার কারণে স্টাফরাও আসছেন ও যাচ্ছেন সময়মতো। এভাবেই ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনা সম্ভব বলে জানান পরিচালক।
চিকিৎসাসেবার বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে আগে পাঁচ শতাংশ টেস্টও হতো না। সেখানে আমরা প্যাথলজি ও ইনডোর প্যাথলজি করেছি। এখন ৮০ শতাংশ টেস্ট রামেক হাসপাতালেই হচ্ছে। আশা করছি, একমাসের মধ্যেই এখানে শতভাগ প্যাথলজিক্যাল ও রেডিওলজিক্যাল টেস্ট সম্পন্ন হবে। এক্ষেত্রে পড়ে থাকা রামেকের সব যত্রাংশ ঠিকঠাক ও মেরামত করা হয়েছে।
খাবারের মানের বিষয়ে পরিচালক ইয়াজদানী বলেন, আসলে মনিটরিংটা হলো সবচেয়ে বড় বিষয়। আগে ঠিকভাবে খাবার মনিটরিং হতো না। কিন্তু বর্তমানে আমি এটি কড়া মনিটরিং করছি। এজন্য একটি কমিটি করে দিয়েছি তারা ভালো খাবার বুঝে নিবে। পাশাপাশি রোগীরা নিচে লাইন ধরে খাবার নেন। এ সমস্যা দূর করার জন্য উন্নত ট্রলির ব্যবস্থার চেষ্টা করছি। যাতে প্রতিটি ওয়ার্ডে খাবার ট্রলিতে করে পৌঁছে দেওয়া যায়।
করোনা ইউনিটের বিষয়ে তিনি বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কোনো রকম সামাল দিতে পেরেছি। কিন্তু তৃতীয় ঢেউ সামাল দেওয়ার জন্য বেশ প্রস্তুতি রয়েছে। আমাদের সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্রসেসিং সিস্টেমের আওতায় অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও পর্যাপ্ত সিলিন্ডারে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে অক্সিজেনের অভাবে রোগী না মারা যায়।
সবমিলিয়ে রামেক পরিচালক শামীম ইয়াজদানীর আশা, রোগীদের হয়রানি দূর করা, দ্রুত সেবাদান। তাদের সম্মান দেওয়া ও সেবার মান উন্নয়ন করা। বর্তমানে চিকিৎসকেরাও অনেকটাই উদ্যোমী হয়েছেন, সেবা অনেক ভালো দিচ্ছেন। কিন্তু করোনার কারণে অনেকটাই ভাটা পড়ছে। মানুষ যখন রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালের নাম শুনবে তখন যেন সম্মানের সঙ্গে নামটা উচ্চারণ করে। আমরা চাই, আমরা ‘ওয়ান অব দ্য বেস্ট’ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হব বাংলাদেশের মধ্যে।
মন্তব্য