নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঝালকাঠি পর্যটনের সম্ভাবনা

পলাশ রায়, ঝালকাঠি 
নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঝালকাঠি পর্যটনের সম্ভাবনা
ঝালকাঠির ভাসমান পেয়ারার হাট। ছবি ভোরের আকাশ

পর্যটনের অপার সম্ভাবনার জেলা ঝালকাঠি। মূলত অসংখ্য নদী আর খাল দক্ষিণ এ জনপদকে নৈসর্গিক সৌন্দর্যে সাজিয়েছে। তাই তো রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তার অসংখ্য কবিতায় মৃত্যুর পরেও ঝালকাঠিতে ফিরে আসতে চেয়েছেন। এ জেলায় প্রাচীনকাল থেকেই ভাসমান হাট-বাজার বসে আসছে। রয়েছে ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং বরণ্য ব্যক্তিদের জন্মস্মৃতি। ঝালকাঠির পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় গেলে মনে হবেÑ ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’ কিংবা পেয়ে যেতে পারেন ইতিহাস আর ঐতিহ্যের শেকড়সন্ধান।

বিশখালির ছৈলার চরজলঘেরা দ্বীপ ঝালকাঠির ছৈলার চর। ঝালকাঠি জেলার কাঁঠালিয়া উপজেলার বিশখালি নদীতে ৪১ একর জায়গাজুড়ে জেগে উঠেছে বিশাল এক চর। আর সেখানে রয়েছে ছৈলার গাছের অরণ্য। মূলত ছৈলা গাছ থেকেই এ চরের নাম হয়েছে ছৈলার চর। চারপাশে নদী ঘেরা যেন ছৈলাবনের দ্বীপ। আর সেখানে লাখ ছৈলাগাছে পাখিরা বেঁধেছে নীড়। শালিক, ডাহুক আর বকের সারি। এখানে এলে যে কেউ সুন্দর বনের আবহে হারিয়ে যাবে।

শের-ই-বাংলার জন্মস্থান সাতুরিয়া জমিদারবাড়িঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া জমিদারবাড়িতে ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর মাতুলায়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ইতিহাসের এক মহানায়ক শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক। তিন শত বছর আগে তৎকালীন সেলিমাবাদ পরগনায় শের-ই-বাংলার মাতামহ (নানা) আলী মিয়া সাতুরিয়া গ্রামে জমিদারি স্থাপন করেন। এই জমিদারবাড়িতে মাতুলালয়ে শের-ই-বাংলার জন্ম। কেবল তাই নয়’ শৈশব-কৈশোর, এমনকী মধ্য বয়সের অনেক সময় এখানেই কেটেছে তার। তিনি এখানকার কৃষকদের দুঃখকষ্ট খুব কাছ থেকে অনুভব করেন। আর তাই ‘লাঙল যার জমি তার’ আন্দোলনের ডাক দেন তিনি। নানা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে এই বাড়িটি।

সতীদাহের স্মৃতিবহ কীর্তিপাশার জমিদারবাড়িদেশের বিভিন্ন স্থানে জমিদারদের বিলাসবহুল মহল দর্শনীয় স্থান। কিন্তু ঝালকাঠি জেলা সদর উপজেলার প্রাচীনতম জনপদ কীর্তিপাশার জমিদারবাড়ির রয়েছে নানা নাটকীয় গল্পবহুল ইতিহাস। দেড় শ বছর আগে কীর্তিপাশার জমিদারপুত্র রাজকুমারকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। সন্দেহের তীর ছোড়া হয় রাজকুমারের স্ত্রীর দিকে। আর নিজেকে সতী প্রমাণ করতে স্বামীর সঙ্গে জ¦লন্ত শ্মশানে সহমরণে যান তিনি। বৃহত্তর বরিশাল বিভাগের প্রাচীন সেই লোমহর্ষক ইতিহাসের সহমরণ সমাধিটি আজও আছে। ভগ্নপ্রায় হলেও আজও আছে নাট মন্দির, নাচঘর, শান বাধান পুকুর।

ঝালকাঠির ভাসমান পেয়ারার বাজারদেশের ব্যাকওয়াটার ট্যুরিজমের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ঝালকাঠির ভাসমান পেয়ারা হাট। খালবিল আর নদীনালা বেষ্টিত এখানকার বিলাঞ্চলের গ্রামগুলো বারো মাস পানি দ্বারা বেষ্টিত থাকে। তাই বিভিন্ন গ্রামে উৎপাদিত সবজি ও ফলমূল নৌকায় করেই বেচাকেনা হয় বারো মাস। ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্তিপাশা ইউনিয়নের ২০টি গ্রামে ৫০০ হেক্টর জমিতে পেয়ারার চাষ হচ্ছে। পেয়ারাকে কেন্দ্র করে প্রায় শত বছর ধরে আশপাশের ২০ গ্রামের মানুষজন ভীমরুলি খালেই প্রধান হাট বসিয়ে আসছে। প্রকৃতির মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠা এ জলের হাটের দৃশ্য উপভোগে দূর-দূরান্তের হাজারো পর্যটক মৌসুমজুড়ে ভিড় করেন। পেয়ারা ও আমড়ার জমজমাট ভাসমান বাজারকে কেন্দ্র করে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পর্যটকের মিলনমেলা বসে এই ভাসমান হাট-বাজারে।

জীবনানন্দের ধানসিঁড়ি ‘হায় চিল /সোনালী ডানায় চিল/ এই ভিজে মেঘের দুপুরে / তুমি আর কেদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে।’ অথবা কালজয়ী কবিতা ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায়’। মৃত্যুর পরেও রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ যে নদীটির তীরে ফিরে আসতে চেয়েছেন, সে নদীটি ঝালকাঠি জেলায় অবস্থিত। ঝালকাঠির সুগন্ধা, বিশখালি আর সুয়েজ খাল গাবখান চ্যানেলের মোহনা থেকে কবিতার সেই ধানসিঁড়ি নদীটি প্রবাহিত হয়েছে।জনশ্রুতি রয়েছে, এককালে নদীটির প্রশস্ততা এমন ছিল যে, এক ডোঙা ধান সিদ্ধের জন্য সে সময় লাগত, নদী পাড় হতেও ততক্ষণ সময় লাগত। তাই সে সময় নদীটিকে ধান সিদ্ধের বাঁকও বলা হতো। আবার কারো কারো মতে, এ নদীর বিশাল চরে ব্যাপক পরিমাণ ধানের চাষ হতো। কৃষকরা সে ধান কেটে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য হাজার হাজার মণ ধান আঁটির ওপর আঁটি বেঁধে সিঁড়ির মতো করে সাজিয়ে রাখত। আর সেখান থেকেই নদীর নাম ধানসিঁড়ি।

নাব্যতা হারিয়ে নদীটি এখন যদিও মরে যাচ্ছে, তবু বয়ে চলা এই ধানসিঁড়ি নদীতে আজও পড়ন্ত বেলায় চলে সূর্যের খেলা। ভিজে মেঘের দুপুরে সোনালি ডানায় চিল উড়ে বেড়ায়। আর নদীর দুই ধারে গড়ে ওঠা বেড়িবাঁধে সারি সারি গাছের ছায়ায় দীর্ঘ মেঠোপথে পর্যটকরা জীবনানন্দকে খুঁজে বেড়ান।

মন্তব্য