উপজেলাটির বেশির ভাগই বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। স্বাস্থ্যসেবা নিতে উপজেলাবাসীকে ছুটতে হয় জেলা শহরে। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হতো গর্ভবতী মায়েদের। বাড়িতেই অপ্রশিক্ষিত ধাত্রী দিয়ে বাচ্চা প্রসব করা হতো। অসচেতনতাসহ নানা কারণে পিছিয়ে ছিল প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবসেবা। ফলে এখানে মাতৃমৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যুহারও ছিল বেশি। তবে এক বছরেরও কম সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবসেবায় রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে উপজেলাটি।
বলছি, নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার কথা। দক্ষ সেবাদানকারীর মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক শতভাগ প্রসবসেবা নিশ্চিত করে মাতৃমৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যু শূন্যের কোটায় নিয়ে আনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এ উপজেলা। সম্পূর্ণ বিনাখরচে প্রসবসেবা নিচ্ছেন মায়েরা। এতে মায়েরা যেমন সুস্থ থাকছেন, তেমনি সুস্থ থাকছে নবজাতকও।
জেলা প্রশাসন, পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত উদ্যোগে শতভাগ প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবসেবা নিশ্চিত করতে পেরে খুশি উপজেলাবাসী। আগামীতে জেলার সব ক’টি উপজেলায় এ সফলতার ধারাবাহিকতার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসন ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মকর্তারা।
কর্মযজ্ঞ
উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের তথ্যমতে, গত বছরের আগস্ট থেকে এ উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবসেবা কার্যক্রম চালু হয়। এর পর থেকেই কমতে থাকে মৃত্যুহার। গত বছরের জুনে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের পরিমাণ ছিল ৫৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ, যা গত বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শতভাগ হয়ে ওঠে।
সরেজমিনে কবিরহাটের ধানশালিক, ধানসিঁড়ি, চাপরাশিরহাট, সুন্দলপুর, ঘোষবাগ ইউনিয়নের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, সকাল ৯টার আগেই গর্ভবতী ও প্রসবপরবর্তী মায়েরা নিজেদের এবং নবজাতকের শারীরিক চেকআপ করতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় আসছেন। তাদের মধ্যে আবার অনেক মা আছেন, যিনি আগেই বেশ কয়েকটি সন্তান নিয়েছেন। আবার অনেকে আছেন যারা নতুন মা হতে চলেছেন।
ধানশালিক ইউনিয়নের খাসমন্ডলিয়া গ্রামের ফাতেমা বেগম (২২)। তার স্বামী ইদ্রিস মিয়া কৃষিকাজ করেন। পাঁচ বছর আগে বিয়ে হয় তাদের। এ সময়ের মধ্যে তিনবার গর্ভধারণ করেন ফাতেমা। প্রথম দুই সন্তানের বেলায় বাড়িতেই ধাত্রীর সহযোগিতায় প্রসব করেন তিনি। তবে মারা যায় ওই দুই নবজাতকই। ১৫ দিন আগে ধানশালিক ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে গিয়ে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব করান ফাতেমা। বর্তমানে ফাতেমা ও তার নবজাতক সুস্থ আছেন।
ফাতেমার মতো এখন এ উপজেলার অনেক মা সময়মতো ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে সম্পূর্ণ বিনাখরচে প্রসবসেবা নিচ্ছেন। এতে মায়েরা যেমন সুস্থ থাকছেন, তেমনি নবজাতকও সুস্থ-স্বাভাবিক থাকছে।
কী বলছেন মায়েরা
ধানসিঁড়ি ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রে কথা হয় সেবা নিতে আসা বেশ কয়েকজন মায়ের সঙ্গে। সেখানে ছিলেন রানী বেগম (২২)। তার চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক। প্রথমবারের মতো মা হয়েছেন তিনি। সন্তানকে কোলে নিয়ে বসে আছেন ডাক্তারের জন্য।
তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে পরামর্শ নিয়ে প্রসবের আগে বেশ কয়েকবার এ হাসপাতালে এসেছি। ১৫ দিন আগে একটি ছেলেসন্তানের জন্ম হয় এখানে। কোনো টাকা-পয়সা ছাড়াই নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। আমি ও আমার সন্তান দুজনই সুস্থ আছি।’
এ হাসপাতালে কথা হয় আরেক গর্ভবতীর সঙ্গে। তিন সন্তানের মা তিনি। ফের গর্ভবতী হয়েছেন এই নারী। স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছ থেকে শুনে তিনিও এসেছেন এ হাসপাতালে ডাক্তারি পরামর্শ ও সেবা নিতে।
পাশের ইউনিয়ন ধানশালিক। ওই ইউনিয়নের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় মায়েদের দীর্ঘ সারি।
ধানসিঁড়ি ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা মনি রানী দাস। তিনি বলেন, ‘ সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এ হাসপাতালে পরিবার পরিকল্পনা সেবার পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টা ডেলিভারি সেবা দেওয়া হয়। যখন মায়েরা চেকআপে আসেন, তখন তাদের মোবাইল নম্বর রেখে দেওয়া হয়। আর আমাদেরটাও তাদের দিয়ে দিই। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা হয়। কোনো সুবিধা-অসুবিধা হলে আমরা সে অনুযাযী পরামর্শ দেই।’
ধানশালিক স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের প্যারামেডিকস রেবেনা খাতুন বলেন, ‘মায়েরা প্রথমে হাসাপাতালে আসতে চান না। কিন্তু যারা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন তারা তাদের অনেক বুঝিয়ে এখানে আনেন। এখানে আসার পর তাদের কাউন্সেলিং করা হয়। এর পর বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রসকালীন, প্রসবোত্তর ও সাধারণ সেবা দেওয়া হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা কোনো কিছুর বিনিময়ে সেবা দেই না। নিরাপদে প্রসবের পর একজন মায়ের মুখে যখন আনন্দের হাসি দেখি, তখন সব কষ্ট ভুলে যাই।’
কীভাবে এলো সফলতা
ধানশালিক ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইয়াকুব নবী জানান, তার ইউনিয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রটি ১৪ বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত ছিল। পরে তিনি উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ও জেলা-উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে কেন্দ্রটি গত বছর চালুর উদ্যোগ নেন।
কবিরহাট উপজেলা পরিবার ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ লোকমান হোসাইন জানান, নোয়াখালীতে শতকরা ৪৪ ভাগ মা বাড়িতে সন্তান প্রসব করে থাকেন। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর অন্যতম একটি কারণ এটি। উপকূলীয় অঞ্চলে অসচেতনতাসহ নানা কারণে পিছিয়ে ছিল প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবসেবা। ফলে এখানে মাতৃমৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যুর হারও ছিল বেশি।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইশরাত সাদমীন বলেন, ‘কবিরহাট উপজেলা প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবে পিছিয়ে ছিল। সেই কবিরহাট উপজেলায় শতভাগ প্রাতিষ্ঠানিক নরমাল প্রসবসেবা নিশ্চিত হয়েছে। এক বছর ধরে উঠান বৈঠক থেকে শুরু করে মা সমাবেশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন পেশাজীবীকে সচেতন করার কাজটিতে নানাভাবে সহযোগিতা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।’
নোয়াখালী পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপপরিচালক একেএম জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে গোটা একটি উপজেলাকে প্রাতিষ্ঠানিক শতভাগ প্রসবসেবার আওতায় আনা খুবই জটিল ছিল। সেভ দ্য চিলড্রেন, মা-মণিসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সহযোগিতা নিয়ে সবার সম্মিলিত চেষ্টায় কবিরহাটকে জিরো হোম ডেলিভারির আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। ভবিষ্যতে জেলার সব উপজেলাকে এ সেবার আওতায় আনা হবে।’
মন্তব্য