কুড়িগ্রাম জেলা শহরের মাঝেই অবস্থান ‘কুড়িগ্রাম মজিদা আর্দশ ডিগ্রি কলেজ’র। এই কলেজের প্রধান ফটকেই অবস্থিত জেলার প্রথম শহীদ মিনার। ১৯৫৩ সালে ভাষা শহীদদের স্মরণে গড়ে তোলা হয় এ স্মৃতি মিনারটি। তবে অযত্ন আর অবহেলায় সারা বছরই অরক্ষিত থাকে শহীদ মিনারটি। ঠিকমতো স্মৃতিস্তম্ভটির রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জেলার ভাষা সৈনিকসহ সাধারণ মানুষেরা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, শহীদ মিনারের যথাযথ মর্যাদা, পবিত্রতা ও ভাবগাম্ভীর্য রক্ষা করা হয় না। সারা বছর ঐতিহ্যবাহী এই শহীদ মিনার বেহাল অবস্থায় থাকলেও ২১ ফেব্রুয়ারিতে কিছুটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। তবে সেটি প্রয়োজনের থেকে খুবই সামান্য। ২১ শে ফেব্রুয়ারির কিছুদিন পর থেকেই আবার বেহাল হয়ে পড়ে শহীদ মিনারটি।
সম্প্রতি শহীদ মিনারটিতে গিয়ে দেখা যায়, অনেকে জুতা-সেন্ডেল পরেই শহীদ মিনারের বেদিতে ঘোরাফেরা করছেন। মিনারের মূল বেদিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে নোংরা ময়লা-আবর্জনা, সিগারেটের প্যাকেটসহ অসংখ্য উচ্ছিষ্ট অংশ। আর ময়লা-আবর্জনায় ভরে রয়েছে চারপাশ। শহীদ মিনারের পেছনে মূত্র ত্যাগ করছেন অনেকে।
শহীদ মিনারের গা ঘেঁষে গড়ে উঠেছে দোকান। আলো কমলেই বসে মাদকসেবীদের আড্ডা। দিনে ও রাতে হরহামেশাই শহীদ মিনারের মূল বেদিতে জুতা-সেন্ডেল নিয়ে ধূমপান করে মানুষ। জেলার প্রথম শহীদ মিনার ও কলেজ প্রাঙ্গণে গড়ে উঠলেও ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও জানেন না এর ইতিহাস। অথচ প্রায় ৬৯ বছর আগে নির্মিত শহীদ মিনারটিকে ঘিরে এক সময় সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হলেও এখন কেউ আর সেখানে যান না।
স্থানীয় বাসিন্দা ইকবাল রাব্বী বলেন, ‘জেলার প্রথম এই শহীদ মিনারটির যত্ন না দেখে আমরা খুব কষ্ট পাই। এখানে সন্ধ্যার পরে মাদক সেবনের বিষয়টিও খুব কষ্ট দেয়।’
কুড়িগ্রাম মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জেলা ইউনিট কমান্ডার মো. সিরাজুল ইসলাম টুকু বলেন, ‘জেলার ভাষা আন্দোলনের সাক্ষী শহীদ মিনারটি সংরক্ষণ করা জরুরি। মজিদা কলেজের প্রধান ফটকের প্রবেশ মুখের বাঁ দিকে কয়েকজন অসম সাহসী প্রগতিশীল স্কুলছাত্র কাদামাটি দিয়ে ইট গেঁথে নির্মাণ করেছিলেন এটি। ছাত্রদের শ্রমে তৈরি এই শহীদ মিনারটি আড়াই যুগ আগেও ছিল শহীদ দিবস পালনসহ সব আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। এখন পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়।’
কুড়িগ্রামের প্রথম শহীদ মিনার তৈরিতে অংশ নিয়েছিলেন ভাষা সৈনিক সামিউল হক নান্টু। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ‘১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় কুড়িগ্রাম ছিল মহকুমা। কুড়িগ্রাম হাই স্কুলের ছাত্ররাই সব আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতেন এবং নেতৃত্ব দিতেন। ঢাকায় ২১ ফেব্রুয়ারির শোকাবহ ঘটনা এখানকার মানুষ জানতে পেরেছিলেন দুদিন পর। এরও কয়েকদিন পর কারমাইকেল কলেজে অধ্যয়নরত ভুরুঙ্গামারীর অধিবাসী মজিবর রহমান এখানে এসে উদ্বুদ্ধ করলে হাই স্কুলের প্রগতিশীল কিছু ছাত্র ঝাঁপিয়ে পড়েন ভাষা আন্দোলনে। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ছাত্ররা প্রথম সমাবেশটি করেন বাজারের কালীবাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায়। এরই ধারাবাহিকতায় কয়েকজন ছাত্র ঝুঁকি নিয়ে ১৯৫৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে চুপিসারে গড়ে তোলেন কুড়িগ্রামের এই প্রথম শহীদ মিনার।’
শহীদ মিনারটির রক্ষণাবেক্ষণের বিষয় জানতে চাইলে কুড়িগ্রাম পৌরসভার মেয়র কাজিউল ইসলাম বলেন, ‘আপাতত পৌরসভা থেকে সেটি সংস্কারের কোনো সুযোগ নেই। এটি কলেজ কর্তৃপক্ষের বিষয়।’
কুড়িগ্রাম মজিদা আর্দশ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ খাজা শরিফ উদ্দিন আলী আহমেদ ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আমরা কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাড়া এখানে প্রশাসন থেকে শুরু কুড়িগ্রামের কোন সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন না। এটা খুব কষ্টের। আর সংস্কারের বিষয় বলতে সেখানে শুধু ২০ তারিখ ধোঁয়া-মোছার কাজ করব, তারপর বর্ণমালা দিয়ে সাজাব।’
মাদকের আড্ডা ও জুতা পায়ে ওঠার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমরা অবগত ছিলাম না। আমরা দ্রুত বেদির পাশ দিয়ে লোহার গ্রিল তৈরি করে দেব, যাতে সেখানে কেউ কোনো প্রকার আড্ডা দিতে না পারে।’
মন্তব্য