মাকে নিয়ে কবি কালিদাস রায়ের ‘মাতৃভক্তি’ কবিতা তো আমরা সবাই শৈশবে পড়েছি। বায়েজীদ বোস্তামী মায়ের ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় সারা রাত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন জলভর্তি গ্লাস হাতে করে, এমন দৃশ্য তো বাস্তবে বিরল!
কিংবা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ঝড়ের রাতে নিজের জীবন বাজি রেখে ভরা নদ সাঁতরে পাড়ি দেওয়ার গল্পও পড়েছি, কেবল অসুস্থ মায়ের কাছে পৌঁছানোর জন্য। এসব কবিতা আর গল্প পড়ে আমাদের নিশ্চয়ই মা প্রেম বুকে আরো জোরালো হয়। কিন্তু আপনি যদি এক দৃষ্টিতেই ৫২ ভাষায় লেখা মা দেখতে পান কেমন বোধ হবে?
কল্পনা নয় এমনই এক স্থাপনায় ৫২ ভাষায় মা লেখা শহীদ মিনার রয়েছে সিলেটের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘লিডিং ইউনিভার্সিটি’ ক্যাম্পাসে। যা সাড়া ফেলেছে সিলেটে ছাড়িয়ে দেশজুড়ে।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কামাল বাজারে লিডিং ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস। এর প্রধান ফটকের পাশে নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন এই শহীদ মিনার। ১৫ শতক জায়গা নিয়ে ২০১৮ সালে শহীদ মিনারটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়; শেষ হয় ২০২০ সালের জানুয়ারিতে। ৩৮ ফুট উঁচু ও ৬০ ফুট চওড়া শহীদ মিনার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকা।
‘মা: অবাক আলোর লিপি’ নামে বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাসে নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ মিনার। এই শহীদ মিনারে স্থান পেয়েছে বাংলাসহ বিশ্বের ৫২ ভাষায় লেখা ‘মা’। রয়েছে মাকে নিয়ে লেখা কালজয়ী একাধিক কবিতার চরণও।
২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি এই শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। এই শহীদ মিনারের স্থপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের প্রধান রাজন দাস। তিনি সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার এবং মদনমোহন কলেজের রিকাবীবাজার ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারের স্থপতিও।
এই শহীদ মিনারে বাংলা ছাড়াও চাকমা, মারমা, ম্রো, মগ, ত্রিপুরা, রাখাইন, মনিপুরী, সিলেটি নাগরী, অহমিয়া, মিজো, পাত্র, খাসিয়া, সাঁওতালদের ভাষায় লেখা ‘মা’ শব্দটি বসানো রয়েছে। অন্যান্য ভাষার মধ্যে সংস্কৃত, আরবী, উর্দু, ফার্সি, পশতু, গ্রিক, রোমান, হায়ারোগ্লাফিক, রেড ইন্ডিয়ানদের ভাষায় ‘মা’ও আছে এখানে।একইসঙ্গে ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, ডাচ, তামিল, গুজরাটি, বার্মিজ, জার্মান ভাষায় লেখা ‘মা’ও রয়েছে। রয়েছে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় মায়ের উচ্চারণ ‘মাইজিও’।
এই স্থাপনার স্থপতি রাজন দাস বলেন, পৃথিবীতে মাত্র দু চারটি ভাষা ছাড়া সব ভাষাতে ‘মা’ শব্দটির শুরু ‘ম ধরণের’ বর্ণ দিয়ে। তাই মাতৃভাষার আন্তর্জাতিকতাবোধের জায়গা থেকে বাংলাভাষা ছাড়াও আমাদের দেশে যেসব নৃগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের ভাষাসহ ৫২টি ভাষায় লেখা ‘মা’ শব্দটি এই শহীদ মিনারে বসানো হয়েছে।’
রাজন বলেন, ‘ মা এবং মাতৃভাষা এই শহীদ মিনারের প্রধান উপজীব্য বিষয়। পৃথিবীতে প্রায় সাত হাজার ভাষা আছে। এর মধ্যে তিন হাজারের মতো বিলুপ্ত হওয়ার পথে।
‘বড় ভাষা ছোট ভাষাকে খেয়ে ফেলছে। সব ভাষা বেঁচে থাকুক, সেই অঙ্গীকারের চিন্তা আছে এই শহীদ মিনার। এটি সূচনা মাত্র। আমরা চাই, সব ভাষা স্থান পাক শহীদ মিনারে। সব মায়ের বুলি স্থান পাক।’
মন্তব্য