শেরপুরের সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকায় দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের ভাষা ও সংস্কৃতি। পাহাড়ে বসবাস করা হাজং, বানাই ও ডালুসহ চার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির ভাষা প্রায় বিলুপ্তির পথে। আর গারো, কোচ ভাষা কোনমতে পরিবার পর্যন্ত টিকে আছে।
নিজের ভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির ভাষায় লেখা বই থাকলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের অভাবে সেগুলো পড়ানো সম্ভব হচ্ছে না কোমলমতি শিক্ষার্থীদের।
ফলে তারা আধো আধো ভাষায় কথা বলতে পারলেও ওই ভাষায় পড়তে ও লিখতে পারছে না।
জেলার শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার বিশাল এলাকাজুড়ে গারো পাহাড় অবস্থিত। এ পাহাড়ি এলাকাসহ সারা জেলায় গারো, হাজং, কোচ, বানাই ও ডালুসহ ছয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির অন্তত ৬০ হাজার মানুষের বসবাস। এসব গোষ্ঠীর মানুষের আছে আলাদা আলাদা ভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতি।
নিজ ভাষায় কথা বলাসহ সামনে এগোতে চান তারা। কিন্তু চর্চা আর সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্তির পথে তাদের মাতৃভাষা। পরিবারের সুখ-দুঃখের গল্প মাতৃভাষায় করলেও এসব জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভবিষ্যৎ স্বপ্নের পথে এগিয়ে যেতে হয় বাংলা ভাষার হাত ধরেই। তাই দিন দিন তাদের মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়ায় আক্ষেপ তাদের।
বয়োজ্যেষ্ঠদের অভিযোগ, তাদের ভাষার চর্চা না থাকায় এখন বাংলা ভাষার মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের মাতৃভাষা।
জানা যায়, ভারতের সীমান্তঘেঁষা বানাইপাড়ায় বেশ কয়েকটি বানাই পরিবার বাস করলেও প্রায় হারিয়েই গেছে ডালু জাতিগোষ্ঠী। ভাষার সঙ্গে হুমকির মধ্যে তাদের সংস্কৃতিও। ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো রূপ না থাকায় হারাতে বসেছে এ দুটি জাতিগোষ্ঠীসহ চারটির ভাষা ও সংস্কৃতি।
সরকার কয়েকটি জাতিগোষ্ঠির শিশুদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে তাদের ভাষায় বই দিলেও তা পড়ানোর মতো কোনো শিক্ষক নেই। তাই নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য বিদ্যালয়ে নিজ ধর্মের শিক্ষক চায় ভিন্ন জাতিগোষ্ঠির শিক্ষার্থীরা।
ঝিনাইগাতী উপজেলার বানাইপাড়া গ্রামের প্রবাদিনী কোচ বলেন, ‘আমরা আমাদের ভাষায় কথা বলতে চাই। কিন্তু বাংলা ভাষায় কথা বলতে বলতে আমাদের ছেলে মেয়েরা আমাগো ভাষা ভুলেই যাচ্ছে। স্কুলে আমাগো ভাষার বই দিছে। কিন্তু সেটা তো পড়ায় না। বাংলাই পড়ায়।’
গজনী এলাকার চাকনী কোচ বলেন, ‘স্কুল-কলেজে আর আমাগো ভাষা শিখায় না। তাই আমাগো পোলাপানরা আমাগো ভাষায় কথা বলতে চায় না। বাংলা ভাষায় কথা কয়।’
‘আমাগো স্কুলে বাংলা ও ইংরেজি ভাষা পড়ায়। আমাগো ভাষার বই দিছে, কিন্তু স্যার নাই’, বলে স্কুলছাত্র স্বপ্ন হাজং।
স্কুল শিক্ষিকা শান্তি রানী বলেন, মান্দি ভাষায় কথা বললেও বাজারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে হয়।
‘আমি যখন ছোট ছিলাম তখন বাংলা ভাষা জানতাম না। স্কুলে যাওয়ার পর বাংলা ভাষা শিখেছি। স্কুলেও আমাদের ভাষা প্রয়োগ হয় না। এতে আমাদের ভাষা বিলুপ্ত হচ্ছে।’
জেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নূরে আলম মির্ধা বলেন, পাহাড়ি উপজেলাগুলোতে জাতিগোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের জন্য ভাষা পারদর্শী শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করি দ্রুত এর সমাধান হবে।
জেলা প্রশাসক মোমীনুর রশীদ বলেন, সীমান্তে একটি একাডেমি স্থাপনের জন্য পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই একটি একাডেমি স্থাপন করতে পারবো।
‘শিক্ষকের বিষয়টা একটু সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, তারপরও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়টি জানাবো’, যোগ করেন মোমীনুর রশীদ।
মন্তব্য