-->
শিরোনাম
মাছ ছাড়াও চলছে কোটি টাকার পাথর লুট

তৎপরতা থামছে না জলদস্যুদের

আহসান সুমন, কক্সবাজার
তৎপরতা থামছে না জলদস্যুদের
বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ট্রলার

কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার প্রায় ৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের অপরূপ এক দ্বীপ সোনাদিয়া। নতুনভাবে পর্যটকদের কাছে পরিচিতি পাচ্ছে এই ইউনিয়ন। প্রতিদিন জঞ্জালমুক্ত সাগর দেখতে সোনাদিয়ায় ভিড় করছেন পর্যটকরা। তবে দস্যুতার জন্য স্থানীয়ভাবে পরিচিতি পাচ্ছে এই উপকূল।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সোনাদিয়া উপকূলে জলদস্যুদের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রছায়ায় থেকে এ দস্যুরা প্রতিনিয়ত লুটপাট চালাচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। বিশেষ করে ওই চক্রটি সম্প্রতি কোটি কোটি টাকার পাথর লুট শুরু করেছে।

ফলে কোনো ব্যবসায়ী এখন সোনাদিয়া উপকূল দিয়ে মালামাল পরিবহণ করতে পারছেন না। আবার অনেকেই সোনাদিয়াকেন্দ্রিক ব্যবসা গুটিয়ে নিতে শুরু করেছেন। সব মিলিয়ে সোনাদিয়া উপকূল এখন লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, একরাম মিয়া নামে স্থানীয় এক ব্যক্তির নেতৃত্বাধীন শক্তিশালী জলদস্যু বাহিনী এই লুটপাটে জড়িত।

সোনাদিয়ার ব্যবসায়ী আবদুস সবুর। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আমরা এখন অসহায়। জলদস্যুদের কারণে দুটি ট্রলার ইতোমধ্যে বিক্রি করে দিয়েছি। অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। অনেক ট্রলার কক্সবাজার প্রবেশ করতে না পেরে চট্টগ্রাম চলে যাচ্ছে। বেশি সমস্যা হলে গভীর সাগরেই মাছ বিক্রি করে দিচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে আসতে চাইলে সোনাদিয়ার মোহনায় জলদস্যুদের কবলে পড়তে হয়। ডাকাতদের চাহিদামতো টাকা না দিলে ট্রলার প্যারাবনের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে। অনেক সময় সব মাছ দিয়ে দেওয়ার পরও মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে জলদস্যুরা। তাদের বেপরোয়া আচরণের কারণে আমরা চরম অসহায়।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সোনাদিয়া ঘটিভাঙ্গা ওয়ার্ডের এক সাবেক মেম্বার বলেন, ‘এই জলদস্যু বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য বিগত সময়ে আত্মসমর্পণ করেছিল। সম্প্রতি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে একরাম মিয়ার নেতৃত্বে তারা পুনরায় সংগঠিত হয়েছে। তারা প্রশাসনকে বিব্রত করে। অনেক সময় মিথ্যা তথ্য দিয়ে কৌশলে নিরীহ মানুষকে জলদস্যু হিসেবে ফাঁসিয়ে দেয়। যোগাযোগব্যবস্থার সমস্যা হওয়ায় প্রশাসনও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না।’

এই জনপ্রতিনিধি আরো বলেন, ‘গত এক মাসে অন্তত সাতটি ট্রলার লুট করেছে এই জলদস্যু বাহিনী। এতে সর্বস্ব হারিয়ে দেউলিয়া হয়েছেন এসব ট্রলারের মালিকরা। অভিযুক্ত একরাম মিয়ার লোকজন এখন অনেকটা অপ্রতিরোধ্য। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলবে এমন কেউ সোনাদিয়া এলাকায় নেই। তাই নির্বিঘ্নেই চলছে তাদের অপকর্ম।’

একই অভিযোগ কক্সবাজারের ফিশিং ট্রলার মালিক ও মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ওসমান গণি টুলুর। তিনি বলেন, ‘জলদস্যুরা খুব বেশি বেপরোয়া হয়ে গেছে। তাদের কারণে সাগরে ট্রলারই যেতে পারে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে মাছ আহরণ বন্ধ করে দিতে হবে।’

জানা যায়, সোনাদিয়া দ্বীপে ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় সরকারের একাধিক মেগা প্রকল্প ছাড়াও এলএনজি টার্মিনালসহ সরকারের স্পর্শকাতর প্রকল্প রয়েছে। এই জলদস্যুদের কারণে এসব প্রকল্পে কাজ করতেও ভয় পাচ্ছে মানুষজন। অনেকেই নিরুপায় হয়ে কাজ করছেন এসব প্রকল্পে।

সোনাদিয়া দ্বীপে পর্যটকের আগমন বেড়ে যাওয়ায় গড়ে উঠেছে পর্যটকদের জন্য রাত্রিযাপন ও খাওয়ার ব্যবস্থা। তাঁবু দিয়ে ছোট ছোট কক্ষ নির্মাণ করে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা করছেন স্থানীয়রা। এসব তাঁবু থেকেও একরাম মিয়া ও তার লোকজনকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয়। না দিলে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁবুগুলো।

নাম প্রকাশ না করে তিনটি তাঁবুর মালিক জানিয়েছেন, যা পাই তার অর্ধেকের বেশি টাকা একরাম মিয়ার লোকজনকে দিতে হয়। মাস শেষে কর্মচারীদের বেতন দিয়ে লোকসান গুনতে হয়। এখন অনেকেই এই ব্যবসা করতে আগ্রহী নয়। এ ছাড়া কিছু করতে গেলেই বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এত বাধা পেরিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ নেই।

এক সময় শুঁটকি মহাল নামে পরিচিতি ছিল সোনাদিয়া। তবে জলদস্যুদের কারণে ইতোমধ্যে শুঁটকির মহাল প্রায় ৭০ ভাগ কমে গেছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে সব শুঁটকি মহাল বন্ধ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

এসব অভিযোগের বিষয়ে একরাম মিয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘কিছু পাথর চরের মধ্যে আছে, তবে এসব পাথর আমরা লুট করিনি। পাথরবোঝাই ভলগেট চরে আটকে যাওয়ায় পাথরগুলো আমরা পেয়েছি। আমি কোনো বাহিনী পালন করি না। যা অভিযোগ করা হয় সবই অপপ্রচার।’ তবে ওই ভলগেটে প্রায় কোটি টাকার পাথর ছিল বলে স্বীকার করেন তিনি।

মহেশখালী-কুতুবদিয়া সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার এম. জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘জলদস্যুদের ব্যাপারে পুলিশের অবস্থান বরাবরের মতোই কঠোর। কোনো অপরাধীকেই ছাড় দেওয়া হবে না।’

মন্তব্য

Beta version