-->
শিরোনাম

প্রতিবন্ধী উজ্জ্বলের জোটেনি ভাতার কার্ড

নেত্রকোনা প্রতিনিধি
প্রতিবন্ধী উজ্জ্বলের জোটেনি ভাতার কার্ড
প্রতিবন্ধী উজ্জ্বলের জোটেনি ভাতার কার্ড

পরিবারের বড় ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন দিনমজুর বাবা। তার স্বপ্ন ছিল এই ছেলে একদিন অভাব-অনটনের সংসারের হাল ধরবে। ফিরিয়ে আনবে আর্থিক স্বচ্ছলতা। কিন্তু বাবার সে স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। উল্টো তার প্রিয় সন্তানটির জীবন জুড়ে নেমে এলো অন্ধকার। মানসিক ভারসাম্যহীন এবং ট্রেনে কাটা পড়ে দুই পা হারিয়ে গত দশ বছর যাবত চরম কষ্টে দিন কাটছে প্রিয় সন্তানের।

বলছি নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের বাসিন্দা দিনমজুর মজিবুর রহমানের ত্রিশ বছর বয়সী ছেলে উজ্জ্বল মিয়ার কথা।

সম্প্রতি হরিপুর গ্রামে গেলে বাড়ির সামনের রাস্তায় দেখা হয় প্রতিবন্ধী যুবক উজ্জ্বল মিয়ার সঙ্গে। এ সময় তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি কোনো কথাই বলেননি। শুধু দূরে অপলক তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে মনে মনে কি যেন বলেছেন। একই সময় কথা হয় উজ্জ্বলের দিনমজুর বাবা মজিবুর রহমান, মা কোহিনূর বেগম এবং ছোট বোন মুক্তা আক্তারের সঙ্গে।

মজিবুর রহমান জানান, স্ত্রী, দুই ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়ে সাত সদস্যের সংসার তার। একটু বসতভিটে ছাড়া আর কোনো সহায় সম্পদ নাই। সন্তানদের মধ্যে উজ্জ্বল সবার বড়। গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিল সে। কিন্তু একমাত্র মজিবুরের আয়ে সংসার চলছিল না। এরজন্য তিনি পনেরো বছর আগে পুরো পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে যান। সেখানে গিয়ে দিনমজুরির কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি ছেলে উজ্জ্বলকেও একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে দেন।

উজ্জ্বল বেশ ভালোভাবেই চাকরি করছিল। বাবার সঙ্গে সংসারের হাল সেও ধরেছিল। এভাবে ভালোই চলছিল তাদের জীবন।

তিনি বলেন, আমি উজ্জ্বলকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম। ভাবছিলাম, এই ছেলেই একদিন সংসারের হাল ধরবে। আমাদের সকল অভাব-অনটন দূর করে সুখ ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু আমার সেই স্বপ্ন আর পূরণ হল না। তার আগেই ছেলেটা আমার হঠাৎ করে উল্টা পাল্টা কথা বলতে (মানসিক ভারসাম্যহীন) শুরু করল। তার চাকরিটাও চলে যায়।

এ সময় উজ্জ্বলের মা কোহিনূর বেগমের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, মাথায় সমস্যা দেখা দেওয়ার পর ছেলেটা আমার ঢাকা শহরে যেখানে সেখানে চলে যেত। তাই আমরা তার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সবাই আবার গ্রামে চলে আসি। কিন্তু গ্রামে এসেও শেষ রক্ষা হল না। দশ বছর পূর্বে হঠাৎ করে উজ্জ্বল একদিন বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে গেল। আমরা তাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম। কোথাও পেলাম না।

তিনি আরো বলেন, ‘তারপর নিখোঁজের দুই মাস পরে হঠাৎ একদিন সংবাদ পেলাম, উজ্জ্বল টাঙ্গাইলের কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি আছে। আমরা সেখানে গিয়ে দেখলাম তার দুটি পা কোমড় পর্যন্ত নেই। পরে জানতে পারি যে, উজ্জ্বলের পা দুটি ট্রেনে কাটা পড়ে। স্থানীয় লোকজন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে রেখে যায়। এ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে আমরা উজ্জ্বলকে বাড়িতে নিয়ে আসি।’

‘সেই থেকে সে এভাবেই বেঁচে আছে। চলাচল করতে পারে না। কারো সঙ্গে কোনো কথাও বলে না। বাড়ি আর বাড়ির আশেপাশে বসে থেকেই সময় কাটে তার। অবশ্য সে আমাদের তেমন কোনো জ্বালাতনও করে না। ছেলেটার এই দুর্দশা মা হয়ে আর সইতে পারছি না।’

উজ্জ্বলের বাবা মজিবুর রহমান এবং মা কোহিনূর বেগম দুজনই অভিযোগ বলেন, ‘দশ বছর ধরে আমাদের ছেলেটা মানসিক ভারসাম্যহীন এবং ট্রেনে কাটা পড়ে দুই পা হারিয়ে অতিকষ্টে দিন কাটাচ্ছে। একটা ভাতার কার্ডের জন্য চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছে বহুবার গিয়েছি। কিন্তু তারা কার্ড করে দেয়নি।’

প্রতিবন্ধী উজ্জ্বলের ছোট বোন মুক্তা আক্তার বলেন, বৃদ্ধ বাবা আর সংসারের হালও ধরতে পারছেন না। আমার প্রতিবন্ধী ভাইয়ের নামে এখনো একটা ভাতার কার্ডও হয়নি। তাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি, সরকার যদি আমার অসহায় ভাই ও আমার পরিবারটির দিকে একটু সুদৃষ্টি দেন তাহলে হয়তো আমাদের দুঃখ-কষ্ট কিছুটা হলেও কমবে।’

এ বিষয়ে কথা হলে স্থানীয় নাজিরপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল আলী বলেন, ‘আমি নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। ইতোমধ্যে একদিন প্রতিবন্ধী উজ্জ্বলের মায়ের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ছেলেটার জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মনিবন্ধন কোনোটাই নেই। আমি তার মাকে বলেছি দ্রুত ছেলেটার জন্মনিবন্ধন করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। খুব তাড়াতাড়ি তার নামে ভাতার কার্ড করে দেওয়া হবে।’

মন্তব্য

Beta version