এক সময় নদীমাতৃক জেলা হিসেবে পরিচিত ছিল শেরপুর। এ জেলায় ছিল প্রায় দেড় ডজন নদী। কিন্তু দিন দিন এসব নদীগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। নাব্যতা হারিয়ে বিলীন হয়ে গেছে অনেক নদী ও খাল-বিল। নদীর বুকে চলছে ফসল আবাদ। নির্মাণ করা হয়েছে ঘর-বাড়িসহ নানা প্রতিষ্ঠান। যার কারণে মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়ার অবস্থায় রয়েছে নদীগুলো।
জানা গেছে, এক সময়ে মৃগী নদীতে ছিল অথৈ জল। শহরের মানুষ প্রশান্তির স্থান ছিল এই নদী। কিন্তু নদীটি এখন আধুনিক পৌর শহরের বর্জ্যের আস্তানা। শহরের বিশাল ড্রেন নামিয়ে দেয়া হয়েছে মৃগী নদীর বুকে। যার কারণে বিলীন হয়ে গেছে নদীর সুস্বাদু মিঠা পানির মাছ।
জেলার প্রায় দেড়শ বছর আগের ইতিহাসে ১৬টি প্রধান নদী ও ৯টি ক্ষুদ্র নদীর কথা উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন ঐতিহাসিক গ্রন্থে যে ১৬টি প্রধান নদীর নাম উল্লেখিত আছে সেগুলো হচ্ছে- ব্রহ্মপুত্র, মালিঝি, সোমেশ্বরী, মৃগী, নেত্রবতী, মহাঋষি, থলঙ্গ, ভোগবতী, খারুয়া, দর্শা, ভুরাঘাট, বলেশ্বরি, সুতি, মরাখড়িয়া, বৃদ্ধ ভোগবতী ও খড়িয়া।
এগুলোর মধ্যে মরা বা আধামরা হয়ে আটটি নদী এখনো কালের সাক্ষী হয়ে কোনো রকম বেঁচে রয়েছে। বাকি আটটি নদী এখন শুধুই ইতিহাস।
যে আটটি নদী টিকে রয়েছে তারমধ্যে ব্রহ্মপুত্র, মৃগী, সোমেশ্বরী ও মালিঝি পূর্ব নামেই এখনো পরিচিত। আর যে চারটি নদীর নাম পরিবর্তন হয়েছে সেগুলো হলো- ভোগবতী থেকে ভোগাই, মহাঋষি থেকে মহারশি, থলঙ্গ থেকে চেল্লাখালি এবং নেত্রবতী থেকে নেতাই নদী। অন্য নদীগুলোর বিলুপ্তি ঘটেছে। অপরদিকে ‘দশানি’ নামে নতুন একটি নদীর সৃষ্টি হয়েছে।
এক সময়ের বিখ্যাত নেতাই নদী নেতাই খালে রূপান্তরিত হয়। পরবর্তীতে একেবারেই হারিয়ে যায়। নতুন প্রজন্ম এই নদীর নামও এখন আর জানে না। অথচ এই নদী সাবেক শেরপুর পরগণার মধ্যে ৪৩ মাইল দীর্ঘ নদ বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।
এছাড়া মৃগী নদীর দৈর্ঘ্য ২৯ মাইল, ব্রহ্মপুত্র নদ সাড়ে ১০ মাইল, মালিঝি সাড়ে ৩৫ মাইল, চেল্লাখালি ১২ মাইল, সোমেশ্বরী সাড়ে ১৮ মাইল, মহারশি ১৫ মাইল এবং ভোগাইনদী ১৬ মাইল দীর্ঘ ছিল। এখন নদীগুলো পরিমাপ করার অবস্থায় আর নেই। আর নকলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সুতি নদীকে ঘিরে বৃটিশে চন্দ্রকোণায় গড়ে ওঠেছিল বিশাল বন্দর। আজ সেই সুতি এখন প্রভাবশালীদের মৎস্য খামারে পরিণত হয়েছে।
হিমালয়ের মানস সরোবর থেকে ব্রহ্মপুত্র নদটি চীন ও ভারত হয়ে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ হয়ে শেরপুর-জামালপুর সীমা রেখায় প্রবাহমান হয়েছে। এই ব্রহ্মপুত্র নদ শেরপুর-জামালপুরের চরাঞ্চলের আশীর্বাদ ছিল। কালের বিবর্তনে আজ নদীটি ছোট একটি খালে পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে উন্নয়ন ও উৎপাদন বাড়াতে ব্রহ্মপুত্র, মহারশি, সোমেশ্বরী, ভোগাই, চেল্লাখালি নদীর স্থানে স্থানে অপরিকল্পিত বাঁধ, সুইস গেট নির্মাণে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে আস্তে আস্তে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে চর জেগে ওঠে।
নদী খননের কার্যকর কোনো উদ্যোগ না থাকায় নাব্যতা হারিয়ে নদীগুলো আজ প্রবাহহীন। নদীর বুকে জেগে ওঠেছে চর। সেই চরে চাষাবাদ করছে মানুষ। আবার কিছু কিছু জায়গায় গড়ে ওঠেছে ঘর-বাড়ি। নানা বিবর্তন পরিবর্তন প্রাকৃতিক অপ্রাকৃতিক ও জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে নাব্যতা হারানো নদীগুলো এখন পরিণত হয়েছে সামান্য জলাধারে। এই নদীগুলোকে বাঁচাতে বিভিন্ন সংগঠন একাধিকবার দাবি জানালেও এখন পর্যন্ত কার্যকর কিছু হয়নি।
সচেতন মহলরা মনে করেন, নদীগুলো খনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। পরিকল্পিত খনন করলে দুইদিকেই লাভ হবে, একদিকে নদীর নাব্যতা ফিরবে, অন্যদিকে খননের ফলে প্রাপ্ত বালু, নুড়ি মূল্যবান খনিজ সম্পদ হিসেবে বিক্রি করা যাবে।
প্রকৃতি ও পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মেরাজ উদ্দিন বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য, মানুষের অসচেতনতার কারণে নদী বা খালগুলোর অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ ছাড়া খাল দখলের প্রতিযোগিতা চলছে। আমরা প্রশাসনের নজরদারির দাবি জানাচ্ছি।’
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ বলেন, ‘খালগুলো আসলে একদিনে ভরাট হয়নি। এটা ধীরে ধীরে হয়েছে। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সঙ্গে নিয়ে জেলার বিভিন্ন খাল খনন কাজ শুরু করেছি। আমার বিশ্বাস, জেলার খনন কাজ শেষ হলে নদী বা খালের পানির প্রবাহ স্বাভাবিক হবে এবং আগের মতোই অস্তিত্ব ফিরে আসবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘নদী থেকে অবৈধ উপায়ে বালু উত্তোলন বন্ধে আমাদের নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে জেলার অনেক জায়গায় বালু তোলার ড্রেজার মেশিন জব্দ করে পোড়ানো হয়েছে।’
মন্তব্য