-->
শিরোনাম

এখনো অরক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান

শাকিল মুরাদ, শেরপুর
এখনো অরক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান
শেরপুর শহরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ

শেরপুরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন অসংখ্য নারী-পুরুষ। গণহত্যার পর কোথাও মাটিচাপা, কোথাও লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে নদীতে। আবার কোথাও হত্যাযজ্ঞের পর লাশগুলোর সৎকার করেছে।

কিন্তু স্বাধীনতার পর এসব বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো কিছু কিছু জায়গায় চিহ্নিত করার পর সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা হলেও দেখাশোনার কেউ না থাকায় দিন দিন তা নষ্ট হচ্ছে। এখনো অধিকাংশ জায়গা চিহ্নিত করা হয়নি স্মৃতিবিজড়িত স্থান হিসেবে।

জানা গেছে, ১৯৭১ সালে জেলাজুড়ে বর্বর পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা হামলা চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাসহ বহু নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুকে গুলি করে হত্যা করে। গণহত্যার পর লাশগুলো কোথাও মাটিচাপা, কোথাও ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে নদীতে। আবার কোথাও হত্যাযজ্ঞের পর লাশগুলোর সৎকার করেছে। এরপর দেশ স্বাধীনের পর ধীরে ধীরে স্মৃতিবিজড়িত কিছু কিছু জায়গা চিহ্নিত করে প্রশাসন।

পরে সেখানে সরকারিভাবে তৈরি করে সংরক্ষণাগার। কিন্তু এখনো অনেক জায়গায় চিহ্নিত হয়নি স্মৃতিবিজড়িত স্থান। আবার যেগুলো চিহ্নিত করে সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলোর দেখাশোনা করার কেউ না থাকায় তা দিন দিন নষ্ট হতে চলছে।

১৯৭১ সালের ২৫ মে নালিতাবাড়ীর উপজেলার নাকুগাঁও সীমান্তের ভোগাই নদী পার হয়ে পাক হানাদার বাহিনী ভারতের বারাঙ্গাপাড়া থানার ডালুতে গণহত্যা চালায়। ওই সময় বাংলাদেশ থেকে ডালুতে আশ্রয় নেওয়া মুক্তিকামী মানুষ ও ভারতীয় নাগরিকসহ দুই শতাধিক নারী-পুরুষ নিহত হয়। পাক হানাদারদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন ৯ জন বিএসএফ সদস্য।

ভারতের কাঁটাতারঘেঁষা নাকুগাঁওয়ে গণহত্যার শিকার বাংলাদেশি মুসলমানদের লাশ দাফন করা হয়। এ ছাড়াও ৯ মাসে ওই স্থানে বিভিন্ন যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর ভারত সরকার তাদের বিএসএফ সদস্যদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করে। সেটিকে আরো বৃহৎ আকারে সংস্কার করে স্মৃতিস্তম্ভটি পুনর্নির্মাণ করে ভারত সরকার। কিন্তু নাকুগাঁওয়ের গণকবরটি এখনো অবহেলায় পড়ে আছে।

ঝিনাইগাতী উপজেলার আহমদনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে হানাদার বাহিনী। সেটি ছিল পাক হানাদার বাহিনীর আঞ্চলিক হেডকোয়ার্টার। পাকবাহিনী এবং তাদের দোসররা আহমদনগর উচ্চ বিদ্যালয়কে নির্যাতনকেন্দ্র ও বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করে। একাত্তরের ৯ মাসই সেখানে চলে তাদের নৃশংসতা।

পাকিস্তানি পশুরা নারী-পুরুষের ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালানোর পর তাদের বগাডুবি ব্রিজে নিয়ে অথবা কোয়ারি রোড, জুলগাঁওয়ে হত্যার পর ওইসব লাশ মাটিচাপা অথবা নদীতে ভাসিয়ে দিত। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঘাগড়া কোনাপাড়া বধ্যভূমির পাশে এলজিইডির অর্থায়নে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও তা অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আর সেটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা এখন গো-চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে।

একই উপজেলার জগৎপুর গ্রামে ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল গণহত্যায় ওই গ্রামের ৪২ জন হিন্দু পরিবারের সদস্যসহ মোট ৫৮ জন নারী-পুরুষকে হত্যা করা হয়। পুড়ে ছারখার করে দেওয়া হয় বাড়িঘর। গণহত্যার ওই স্থানটিতেও স্মৃতিস্তম্ভ হয়নি। জেলায় এখন অনেক স্থান আছে যা আজো চিহ্নিতটুকুও করা হয়নি, সংরক্ষণ করা হয়নি স্মৃতিবিজড়িত আশপাশের স্থান। তাই স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা দাবি তুলেছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে যুদ্ধদিনের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করা হোক।

শ্রীবরদী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মো. হামিদুর রহমান বলেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এখনো অবহেলিত, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের এখনো কার্ড করে দেওয়া হয়নি, বারবার শুনতেছি কার্ড কওে দেবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখনো সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। এ ছাড়া অনেক স্মৃতিচিহ্ন এখনো সংরক্ষণ করা হয়নি। কিছু কিছু জায়গায় সংরক্ষণাগার থাকলেও জনবল না থাকায় সেগুলো নষ্ট হতে চলছে। তাই সরকারের কাছে দাবি জানাই, এসব স্থানে একজন প্রহরী নিয়োগ দেওয়া হোক।

জেলায় দুবার (বীরপ্রতীক বার) পাওয়া জহুরুল হক মুন্সি বলেন, ‘এখনো অবহেলিত জেলার মুক্তিযোদ্ধারা। আর এখনো সংরক্ষণ করা হয়নি স্মৃতিবিজড়িত অনেক স্থান। আর যেগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে জনবল না থাকায় সেগুলোও নষ্ট হতে চলছে। ’ তাই সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে এসব জায়গা চিহ্নিত ও সংরক্ষণের পাশাপাশি জনবল নিয়োগের জোর দাবি জানান।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার নুরুল ইসলাম হিরু বলেন, ‘আমি দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে জেলার কয়েকটি বধ্যভূমি ও গণকবরের স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছিলাম। ’

তিনি আরো বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মে ওইসব স্মৃতিচিহ্ন সরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণের দাবি জানান ‘এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোমিনুর রশীদ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের গণকবর ও বধ্যভূমিসহ স্মৃতিচিহ্নগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী। সেগুলো সংরক্ষণে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক ইতিপূর্বেই জেলা পর্যায়ে এলজিইডির মাধ্যমে তালিকা প্রস্তুত করে উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। এখন অনুমোদন ও বরাদ্দ পেলেই সেগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ ও বাস্তবায়ন করা হবে। ’

তিনি আরো বলেন, ‘সম্প্রতি নালিতাবাড়ীর সোহাগপুর বিধবাপল্লীতে স্মৃতিসৌধ ‘সৌরজায়া’ নির্মাণ করা হয়েছে।’

মন্তব্য

Beta version