-->
শিরোনাম
নারী চা শ্রমিকদের আড়ালের জীবন

বেশি কাজ করেও মজুরি কম পান নারী শ্রমিকরা

পুলক পুরকায়স্থ, মৌলভীবাজার
বেশি কাজ করেও মজুরি কম পান নারী শ্রমিকরা
মৌলভীবাজারের ভাড়াউড়া চা বাগানে কর্মরত নারী চা শ্রমিকরা

অধিকাংশ সময় চা গাছের ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ তোলার কাজে ব্যস্ত থাকেন নারী শ্রমিকরা। কারণ এ কাজে কুঁড়ি উত্তোলনে পুরুষ শ্রমিকদের থেকে নারী শ্রমিকরা অধিক দক্ষ। তাই চা শিল্পের সঙ্গে নারী শ্রমিকদের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।

মূলত পাহাড়ের টিলায় প্রত্যেক নারী শ্রমিকের জীবনের ৩০ থেকে ৩৫টি বছর কেটে যায়। কিন্তু চা-বাগানের সবুজ বুকে পাতা তোলার ছবি যতটা চোখকে মুগ্ধ করে, এই নারীদের জীবনের গল্প ততটা আনন্দদায়ক বা সৌন্দর্যে মোড়া নয়।

জানা গেছে, সারা দেশে ১৬৬টি চা বাগান রয়েছে। এর মধ্যে মৌলভীবাজার জেলায় রয়েছে ৯২টি। জেলায় দৈনিক ১২০ টাকা মজুরিতে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে নারী শ্রমিকরা বিশাল বাগানের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চায়ের পাতা তোলেন। তারা দল বেঁধে পাহাড়ের পর পাহাড়ের গাঁ বেয়ে টিলায় টিলায় এই কাজ করেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে পর্যাপ্ত খাদ্য, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকারও ঠিকমতো পান না তারা। অপুষ্টি দরিদ্রতায় যেন নতজানু এক একটি চা শ্রমিকের পরিবার।

মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন চা বাগানের একাধিক নারী শ্রমিক জানান, তারা প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজ করেন। আর পুরুষ শ্রমিকরা কাজ করেন তিন থেকে চার ঘণ্টা। অথচ উভয়ই সমান মজুরি পান।

এই মজুরির টাকাও সব সময় তুলতে পারেন না নারী শ্রমিকরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দিন শেষে বাগান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নারী শ্রমিকদের পক্ষে তাদের স্বামী বা পরিবারের পুরুষরা মজুরির টাকা উত্তোলন করেন। নিজের পরিশ্রমের টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রেও নারীদের মতামত নেওয়া হয় সামান্যই।

চা বাগানের শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রতিদিন ৩০ কেজির বেশি চা পাতা উত্তোলন করলে প্রতি কেজির বিপরীতে একজন শ্রমিককে পাঁচ টাকা করে বাড়তি দেওয়ার কথা। তবে এক্ষেত্রে নারীদের কম দেওয়া হয় বলে অভিযোগ শ্রমিকদের।

স্থানীয় পরিবেশ কর্মী কাজল হাজরা বলেন, ‘পুরুষ শ্রমিকরা পদোন্নতি পেয়ে ‘সরদার’ বা ‘বাবু’ হলেও নারী শ্রমিকদের সাধারণত পদোন্নতি দেওয়া হয় না। এছাড়া মাতৃত্বকালীনও বঞ্চনার শিকার হন চা বাগানের নারী শ্রমিকরা।’

জেলা চা কন্যা নারী সংগঠনের সভাপতি খাইরুন আক্তার বলেন, ‘বাগানে নারীরা বেশি পরিশ্রম করেন, অথচ মজুরি পান পুরুষের সমান। আবার অতিরিক্ত পাতা উত্তোলন করেও নির্ধারিত বোনাস পান না।’

চা শ্রমিক অধিকারকর্মী মোহন রবিদাস বলেন, ‘অনেক প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে নারী চা-শ্রমিকদের কাজ করতে হয়। কর্মক্ষেত্রে পয়ঃনিষ্কাশন ও সুপেয় পানির অভাবে নারী চা-শ্রমিকরা অনেক কঠিন রোগের শিকার হন। চা-বাগানগুলোতে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার মানের অবস্থা খুবই নাজুক। এখানে স্বাস্থ্যসেবার নামে চলে রসিকতা।’

চা শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা মিন্টু দেশোয়ারা বলেন, ‘দেশের সব চা বাগানেই প্রধান শ্রমিক মূলত নারীরা। অন্যদিকে পুরুষরা অনেকসময় কাজে ফাঁকি দিলেও নারীরা তা করেন না। সে হিসেবে পুরুষদের চেয়ে নারীদের মজুরি বেশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দু’জনের মজুরিই সমান। তার উপর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীদের মুজরির টাকা তাদের স্বামীরা সংগ্রহ করেন। নিজেদের টাকা সাধারণত নারীরা ব্যয় করতে পারেন না।’

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি রামভজন কৈরি নারীদের বঞ্চনার উদাহরণ দিয়ে জানান, মাতৃত্বকালীন ক্ষেত্রে চা বাগানের নারী শ্রমিকদের পূর্ববর্তী তিনমাসের কাজের উপর ভিত্তি করে ভাতা দেওয়া হয়। ফলে কিছু বেশি ভাতা পাওয়ার জন্য গর্ভাবস্থায় বাগানের নারীরা আরো বাড়তি পরিশ্রম করেন। এতে মা ও সন্তান দুজনেই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে।

চা তুলে বাগান থেকে বের হচ্ছেন নারী শ্রমিকরা

 

‘অন্য চাকরির ক্ষেত্রে নারীরা ছয় মাসের ছুটি পেলেও চা শ্রমিক নারীরা পান তিন মাসের। এছাড়া পরিবারেও নারীরা বঞ্চনার শিকার হন। দীর্ঘদিন কাজ করলেও নারীরা সাধারণত পদোন্নতি পান না।’

মন্তব্য

Beta version