-->
শিরোনাম

সংগ্রামী নারী অর্চনা বিশ্বাস

এইচ আর তুহিন, যশোর
সংগ্রামী নারী অর্চনা বিশ্বাস

নারীর অধিকার, ক্ষমতায়ন ও অগ্রগতির আন্দোলনে অগ্রভাগে রয়েছেন যশোরের অর্চনা বিশ্বাস। তিনি একজন সংগ্রামী নারী। দীর্ঘদিন ধরে নারীর অধিকার ও উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন। তার কাজের স্বীকৃতিও দিয়েছে রাষ্ট্র।

নারী অধিকার সংরক্ষণে বিশেষ অবদান রাখায় সরকার তাকে ‘বেগম রোকেয়া পদক-২০২১’-এ ভূষিত করেছে। অর্চনা বিশ্বাস মনে করেন, সমাজে নারী শিক্ষার অভাব রয়েছে। নারীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। অর্থনৈতিকভাবে নারীরা স্বাবলম্বী হলেই তাদের ওপর নির্যাতন, অবহেলা ও অসম্মান কমে যাবে।

শিক্ষা ও কর্মজীবন

অর্চনা বিশ্বাস ১৯৮৩ সালে এসএসসি, ১৯৮৫ সালে এইচএসসি, ১৯৮৭ সালে বিএ এবং ১৯৯০ সালে এমএসএস সফলতার সঙ্গে পাস করেন। লেখাপড়া চলাকালে তিনি সংসার, সন্তান লালন-পালন, চাকরি করেছেন। এ সময় তাকে অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়েছে। অর্চনা বিশ্বাস চাকরিক্ষেত্রে আত্মনিবেদনের ফলে উত্তরোত্তর উন্নতি করতে থাকেন। ১৯৭৯ সালে একটি বেসরকারি সংস্থায় বস্তিতে শিক্ষা সেবিকা হিসেবে কাজ শুরু করলেও পরে তিনি শিশু শিক্ষা প্রকল্পের শিক্ষক, শিক্ষা সমন্বয়কারী, কর্মসূচি সমন্বয়কারী, প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী এবং প্রকল্প পরিচালক পদে উন্নীত হন। বর্তমানে তিনি একটি প্রতিষ্ঠিত নারী সংগঠন ‘জয়তী সোসাইটি’র নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।

অর্চনা বিশ্বাস নড়াইল জেলার নলদীর চর গ্রামে উর্মিলা ও পুলিন বিশ্বাসের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। নিম্নবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্ম নিয়েও তিনি ছিলেন একটু ব্যতিক্রম মননের অধিকারী। সাত ভাই-বোনের মধ্যে তিনি প্রথম। ছোটবেলা থেকেই গ্রামীণ নারীদের তথা গরিব মানুষের শ্রেণি-বৈষম্য, নির্যাতন, অসমতা তার মনকে আন্দোলিত করত। আর এর সমাধান খুঁজতে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তার ছোট কাকার (প্রফেসর হরিপদ বিশ্বাস) অনুপ্রেরণায় স্কুলে, গ্রামে ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে মেয়েদের সংঘবদ্ধ করে প্রতিবাদ করেন। এভাবে সমাজের নির্যাতিত মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন।

বেগম রোকেয়া পদক-২০২১ পেয়েছেন অর্চনা বিশ্বাস

সমাজ উন্নয়নে অবদান

অর্চনা বিশ্বাস গরিব শিশুদের জন্য বস্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ছয়টি স্কুল। প্রায় ১২ হাজার শিশুকে শিক্ষার আলো দেখিয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৪ হাজার জন উচ্চশিক্ষা লাভ করে বিভিন্ন চাকরি-ব্যবসা করছেন। ১৯৮৭ সালে তিনি যশোর শহরে নাজির শংকরপুরে ১৬ কাঠা জমির ওপর শিশু স্বর্গ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন।

বর্তমানে দোতলা ভবনবিশিষ্ট এ বিদ্যালয়ে ১৪টি কক্ষ ও শিক্ষার্থী প্রায় ৪০০। চাকরিরত অবস্থায় তিনি যশোর শহরে প্রায় ৫ হাজার নারীকে বয়স্ক শিক্ষার আলো দেখিয়েছেন। যশোর শহরে বস্তিতে ৫৪টি পাড়ায় নারীদের সংগঠন গড়ে তুলেছেন, যার সদস্য সংখ্যা ১৬ হাজার। যৌতুক, তালাক, ইভটিজিং, বাল্যবিয়ে ও নারীদের নির্যাতন সম্পর্কিত আইন সচেতনতা সৃষ্টিতে সহায়তা করেছেন।

ওয়ার্ডভিত্তিক কিশোর-কিশোরীদের সংস্কৃতিমনা করে গড়ে তুলেছেন। নারীদের খেলাধুলা, যশোর শহরে প্রথম মোটরসাইকেল চালানো, গাড়ি চালাতে উৎসাহিত করেছেন। প্রথমে নিজে চালিয়েছেন এবং পরে ১২ জনকে মোটরসাইকেল চালাতে সহায়তা করেছেন। নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নারী ও শিশুদের ক্রীড়া, ব্যায়াম, যশোর শহর তথা বাংলাদেশে প্রথম মহিলা ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছেন। এ প্রতিযোগিতায় ২৫০ নারী অংশ নেন। পাঁচজনকে ফুটবল খেলায় উদ্বুদ্ধ করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাঠিয়েছেন।

তার সফলতম অন্যতম কর্মসূচি হচ্ছে, ‘৬০-ঊর্ধ্ব নারীসেবা কর্মসূচি’। ‘বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক বয়স্কদের জন্য নিরাপদ আনন্দ আশ্রম’-এ স্লোগান সামনে রেখে পরিবার ও সমাজে এমন একটি পরিবেশ নিশ্চিত করা। যেখানে বয়স্ক ৬০-ঊর্ধ্ব নারীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ও আনন্দময় জীবনযাপন করবেন। এ মন্ত্রকে পুঁজি করে ১৫০ ষাটোর্ধ্ব দুস্থ মাকে নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন নারীসেবা কর্মসূচি।

তাদের নিয়মিত চিকিৎসাসেবা, শীতবস্ত্র ও খাদ্যসামগ্রী দিয়ে থাকেন। নারীদের আয় বৃদ্ধির জন্য যশোরে প্রথম নারী দ্বারা পরিচালিত বাংলা ও চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, বিউটি পার্লার, ফিটনেস সেন্টার, কমিউনিটি সেন্টার, সভাকক্ষ ও গেস্ট হাউস পরিচালনা। এখানে ৩০ নারী ও ১০ পুরুষ কর্মরত আছেন। নারীদের আয় বৃদ্ধির জন্য ৩২ জনকে লন্ড্রি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ৬০ জন মেয়েকে হাউস ওয়ারিং প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। বর্তমানে যশোর শহরে ৫৪টি নারী সংগঠন তাদের নিজেদের অর্থ ও ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পদক পেয়েছেন অর্চনা বিশ্বাস

কাজের স্বীকৃতি

ইন্টারন্যাশনাল ভলান্টরি সার্ভিস (আইভিএস)-১৯৮৭ গ্রামসেবী সম্মাননা, ইন রিকগনাইজেশন অব টেন টাইমস ভলান্টরি ব্লাড ডোনেশান অ্যাওয়ার্ড-২০১১, সফল সংগ্রামী নারী সম্মাননা (মহিলা অধিদপ্তর, যশোর), খুলনা বিভাগীয় জয়িতা সম্মাননা, জাতীয় জয়িতা সম্মাননা, ইনস্পিরিং রিজিওনাল লিডার (খুলনা বিভাগ) সম্মাননা, বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার ফেস্ট অ্যাওয়ার্ডসহ (বিএফএস ও ইউএসএআইডি) বিভিন্ন সম্মাননা তিনি পেয়েছেন। অর্চনা বিশ^াসকে নারী অধিকার সংরক্ষণে বিশেষ অবদান রাখায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ‘বেগম রোকেয়া পদক-২০২১’-এ ভূষিত করেছে।

এ ছাড়া তিনি নারীপক্ষ, ঢাকা নামে একটি সংগঠনের সভানেত্রী, ঐতিহ্যবাহী নাট্য সংগঠন বিবর্তন যশোর ও যশোর জেলা উইমেন বিউটি পার্লার অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা, যশোর জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির নির্বাহী সদস্য, ক্রিশ্চিয়ান চার্চ ট্রেড স্কুল (সিসিটিএস, যশোরের নির্বাহী সদস্য, যশোর ইনস্টিটিউট, জাগরণীচক্র ফাউন্ডেশন, সুরধনী সংগীত একাডেমি, ভৈারের সাথীর (শরীর চর্চার গুরুত্ব বিষয়ক সংগঠন) সাধারণ সদস্য। তাছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে।

মন্তব্য

Beta version