সামিনা আক্তার। মাত্র মাত্র ১৩ বছর বয়সে অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন বিয়ে হয় তার। কয়েক বছরে মধ্যে সংসারে শুরু হয় অশান্তি। সারা দিন সংসারের ঘানি টেনেও স্বামীর মন জয় করতে পারেননি। বাধ্য হয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে আলাদা থাকা শুরু করেন সামিনা। এ সময় প্রশিক্ষণ নিয়ে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন তিনি। সেই সামিনা এখন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা।
শত নারীর প্রেরণা সামিনা। নিজে গড়েছেন প্রতিষ্ঠান। এখন সেই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৩০০ নারী প্রশিক্ষণ নিয়ে হয়েছেন স্বাবলম্বী। সামিনা অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের। প্রতিরোধ করছেন নারী নির্যাতন, বাল্যবিয়ে।
শুধু তা-ই নয়, অদম্য সামিনা আবার লেখাপড়া শুরু করে এবার তিনি স্নাতক (পাস কোর্স) চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেন। তার বড় ছেলেও এ বছরই নীলফামারী সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক (অনার্স) পাস করেছে আর ছোট ছেলে পড়ছে সপ্তম শ্রেণিতে।
সামিনা আক্তার নীলফামারীর ডোমার উপজেলার বোড়াগাড়ীর সবুজপাড়া গ্রামের ছামছুল হকের মেয়ে। সংসার জীবনের শুরুতেই অবহেলা আর লাঞ্ছনা সইতে হয় সামিনাকে। স্বামীর বাড়ি থেকে চলে আসার পর উপলব্ধি করেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। শুরু করেন লেখাপড়া। সংসার ও লেখাপড়ার পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নারী উন্নয়নের বিভিন্ন সেমিনার ও প্রশিক্ষণে অংশ নেন। একনিষ্ঠ প্রচেষ্টায় বদলাতে থাকে সামিনার জীবনের গল্প।
যুব উন্নয়ন থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ নেন। এভাবেই কর্মজীবনে প্রবেশ তার। স্বল্প সময়ে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন নিজেকে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে তিনি এখন নিজেই কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এরই ফলস্বরূপ পেয়েছেন উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার।
উদ্যোক্তা সামিনা বলেন, ‘যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে সেলাই প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আরো অনেক প্রশিক্ষণ করি। এরপর ওখানে ভ্রামমাণ টেনিং ৭-১০ দিনের প্রশিক্ষণ করাই। সব প্রশিক্ষণ করানোর ফলে আমার কিছু টাকা হলে উপজেলা পরিষদের এই দোকানটি ভাড়া নিয়ে কাজ শুরু করি। এখানে অনেকেই কাজ করে পাশাপাশি আমি প্রশিক্ষণ করাই। আবার ব্র্যাক থেকে সেলাই প্রশিক্ষণের টিটি হিসেবে আছি।’
স্বপ্ন সারথি সাবিনা আরো বলেন, পাড়ায় পাড়ায় সেলাই প্রশিক্ষণ করিয়েছি, দোকানে করিয়েছি। ব্র্যাকে ২০১৬ সাল থেকে থেকে আছি। সেখানে প্রতিটা ব্যাচে ৫০ জনকে প্রশিক্ষণ করাচ্ছি।’
সাবিনা আরো বলেন, ‘আমার একটা সংগঠন আছে। সেখান থেকে আমি নারী নির্যাতন বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কাজ করি। স্যানিটেশন, গাছের চারা বিতরণ, অসহায় স্কুলের বাচ্চাদের স্কুলব্যাগ খাতা-কলম দিয়ে সহযোগিতা করে আসছি।’
সামিনার কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়া দশম শ্রেণির ছাত্রী সুলতানা রাজিয়া সুরভী বলেন, ‘আমি এখানে কাজ শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। সামিনা আন্টির আমাদের কাজ শেখায়। অনেকে এখান থেকে কাজ শিখে আজ স্বাবলম্বী। আমি এই কাজটা শিখে লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে চাই, আর কারো বোঝা হয়ে থাকত চাই না।’
ডোমার প্রেসক্লাবের সভাপতি আসাদুজ্জামান চয়ন বলেন, ‘সামিনা বর্তমানে একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তার দেখাদেখি ডোমারে আরো অনেকে উজ্জীবিত হয়ে নারী উন্নয়নে কাজ করে এগিয়ে যাচ্ছে। সে জয়িতা পুরস্কার পেয়েছে। আমরা আশা করি, সে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।’
সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা এস এম হাবীব মর্তুজা বলেন, ‘সামিনা আমাদের এখানে প্রতিষ্ঠানিক টেনিং করে। সে নীলফামারী থেকে চার মাসের একটা কোর্স ডোমার উপজেলায় পরিচালিত হয়। সেখানে সে অংশগ্রহণ করে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রথম ৪০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করে। এরপরে সে সেলাই মেশিন কিনে বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করে। সামিনা উন্নয়নের পথিকৃৎ হিসেবে কাজ করছে। তাকে দেখে অন্য বেকার যুব মহিলারা উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছে।’
ডোমার উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা (অতিরিক্ত) নূরন্নাহার শাহাজাদী বলেন, ‘সামিনা একবার জয়িতা হয়েছিলেন। উনি একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। আমাদের থেকে তাকে উদ্বুদ্ধ হতে যথেষ্ট সাহায্য করা হয়েছে। তাকে দেখে ডোমারের পিছিয়ে পড়া নারীরা এগিয়ে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
মন্তব্য