-->

কটূক্তি-রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে চম্পার ছুটে চলা

পার্থ পবিত্র হাসান, পাবনা
কটূক্তি-রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে চম্পার ছুটে চলা
জান্নাতুল সরকার চম্পা

প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে মোটরসাইকেলের দুই পাশে ব্যাগভর্তি সংবাদপত্র নিয়ে ছুটে চলেন এক নারী। তার পরনে থাকে সালোয়ার-কামিজের ওপরে সাদা অ্যাপ্রোন, মাথায় ক্যাপ আর সানগ্লাস। ঝড়-বৃষ্টি, শীত কোনো কিছুর কাছে হার না মেনে গত পাঁচ বছর ধরে পাবনার চাটমোহর উপজেলা সদরের বিভিন্ন অলিগলিতে সংবাদপত্র বিক্রি করেন তিনি।

প্রথম প্রথম মানুষ অবজ্ঞা করে নানা কথা বললেও আত্মবিশ্বাস আর কঠোর পরিশ্রমের ফলে এখন সবার কাছে অদম্য সংগ্রামী এক নারী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। বর্তমানে এই নারী একজন জনপ্রতিনিধিও। বলছি খবরের ফেরিওয়ালা জান্নাতুল সরকার চম্পার কথা। তিনি পাবনার চাটমোহরের পার্শ্বডাঙ্গা ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য মৃত ইসহাক আলী সরকারের দ্বিতীয় সন্তান।

মূলত ২০০৪ সালে এইচএসসি পাসের পর চম্পার স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। এর মধ্যেই বাবা মারা যান। সংসারে নেমে আসে অসচ্ছলতা। ভেস্তে যায় পড়ালেখার স্বপ্ন। ২০০৫ সালে তাকে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। সুখের স্বপ্ন নিয়ে সংসার শুরু করলেও স্বামী মাদকাসক্ত হওয়ায় অল্পদিনেই ভেঙে যায় সংসার। এরপর বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন চম্পা। অসচ্ছলতা সেখানেও হানা দেয়। ভাইয়েরা সব আলাদা সংসার গড়ে। ছোট এক ভাই ও মাকে নিয়ে শুরু হয় চম্পার নতুন পথচলা।

২০০৭ সালে নিজের এলাকায় একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক চাকরি নেন চম্পা। পরে বদলিজনিত কারণে চাকরিটা ছাড়তে হয় তাকে। আবার শুরু হয় অভাব-অনটন। কাজের সন্ধানে মানুষের দারে দারে ঘুরে নিরাশ হতে হয় জীবনে বহু ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করা চম্পাকে। জীবিকার তাগিদে শেষ পর্যন্ত হকারিকে পেশা হিসেবে বেছে নেন।

স্থানীয় সংবাদকর্মীদের সহযোগিতায় ২০১২ সালে মাত্র ১০টি পত্রিকা নিয়ে শুরু করেন সংবাদপত্র সরবরাহ কর্মীর কাজ। প্রতিদিন ভোরে গ্রাম থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে পত্রিকা বিলি করতে থাকেন চম্পা। বর্তমানে সাইকেলের বদলে মোটরসাইকেল চালিয়ে প্রতিদিন ৩৫০ কপির বেশি সংবাদপত্র বিক্রি করছেন চম্পা। সেই উপার্জনে সচ্ছলতা ফিরেছে তার পরিবারে। এখন তিনি একজন স্বাবলম্বী নারী।

একই সঙ্গে সমাজপতিদের কটূক্তি ও রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ২০২১ সালের তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়ে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সংগ্রামী এই নারী।

‘খবরের ফেরিওয়ালা’ চম্পা বলেন, ‘কোনো কাজকেই আমি ছোট করে দেখি না। প্রথমদিকে অনেকে কটূক্তি করতো, আমারও খারাপ লাগত। কিন্তু এখন সব ঠিক হয়ে গেছে। একটা সময় না খেয়ে থাকলেও কেউ খাবার দিত না। সুতরাং কারো কথায় কিছু যায় আসে না।’

চম্পা বলেন, ‘চাটমোহর উপজেলার পার্শ্বডাঙ্গা ইউনিয়নের সংরক্ষিত-২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়েছি। মানুষ ভালোবেসে আমাকে বিজয়ী করেছে। সংবাদপত্রের সঙ্গে আত্মার একটা সম্পর্ক রয়েছে, তাই মেম্বার নির্বাচিত হলেও সংবাদপত্র বিক্রি চালিয়ে যাব।’

তিনি আরো বলেন, ‘নিজের জীবনের সংগ্রাম দেখেই বুঝেছি একজন নারীর কতো ধরনের বাধা অতিক্রম করতে হয়। তাই অবহেলিত নারীদের নিয়ে কাজ করতে চাই। আশা করি, সবার সহযোগিতা পেলে সেটা আমি করতে পারব।’

এ দিকে শুরুতে ব্যঙ্গ করলেও এখন চম্পাকে বেশ সম্মানের চোখে দেখছেন স্থানীয়রা।

পাবনা প্রেসক্লাবের সভাপতি এ বি এম ফজলুর রহমান বলেন, চম্পা এলাকায় একজন সাহসী নারী হিসেবে পরিচিত। তার কর্মস্পৃহা নারীদের কাজ করতে সাহস জোগাবে।

মন্তব্য

Beta version