-->
শিরোনাম

অসহায় শিশুদের মাঝে আলো ছড়াচ্ছেন জাহানারা

রেজাউল করিম লিটন, চুয়াডাঙ্গা
অসহায় শিশুদের মাঝে আলো ছড়াচ্ছেন জাহানারা
এতিম শিশুদের পড়াচ্ছেন জাহানারা খাতুন

জাহানারা খাতুন তখন বেশ ছোট। বয়স ৯ বছরের মতো হবে। বাবা-মায়ের সঙ্গে রাজশাহীতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে চুয়াডাঙ্গা রেলস্টেশনে এসেছিলেন তিনি। তখন ট্রেনের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে তাদের। পাশেই এক ব্যক্তি শিঙাড়া বিক্রি করছিলেন। এক পথশিশু সেই শিঙাড়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। মাঝে মধ্যে এ পকেট, সে পকেটে হাত দিচ্ছিল। কিন্তু তার কোনো পকেটেই টাকা ছিল না। জাহানারার ইচ্ছে করছিল শিশুটিকে শিঙাড়া কিনে দিতে। কিন্তু ভয়ে বাবা-মাকে সে কথা তার আর বলা হলো না।

এমন সময় ট্রেন চলে আসল। মা-বাবার সঙ্গে জাহানারা ওঠে গেলেন ট্রেনে। প্রায়ই সেই স্মৃতি কষ্ট দিত তাকে। এভাবে কেটে গেল আরো কয়েক বছর। একসময় পথশিশুদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে জাগে তার মনে।

সোমবার ভোরের আকাশের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন জাহানারা খাতুন। বর্তমানে ৭০ জন অসহায় শিশু তার স্কুলে পড়াশোনা করে। এসব অসহায় শিশুদের কাছে তিনি মনি মা হিসেবে পরিচিত।২০১৮ সালের ৯ ডিসেম্বর সামাজিক উন্নয়ন বিভাগে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত করে জাহানারাকে সম্মাননা স্মারক দেয় চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসন।

ব্যক্তিগত জীবনে জাহানারা খাতুন সেনা সদস্যের স্ত্রী ও এক সন্তানের জননী। ২০০৮ সালে রাজশাহী আদর্শ গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০১০ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর রাজশাহী ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউট থেকে প্যাথলজিতে ডিপ্লোমা করেন তিনি।

বর্তমানে স্কুল চালানোর জন্য বিউটিফিকেশনের কাজ করেন জাহানারা। তিনি একজন প্যাথলজিস্টও। দামুড়হুদার ডায়াবেটিকস হাসপাতালে একবেলা সার্ভিস দিয়ে যা পান সেটা খরচ করেন স্কুলে। এছাড়াও বুটিকস, ব্লক, বাটিকের কাজ করে অনলাইনে বিক্রি করেন। এতে যা আয় হয় সেটাও খরচ করেন স্কুলের বাচ্চাদের জন্য।

জাহানারা জানান, ২০০৭ সালে জাহানারা যখন নবম শ্রেণির ছাত্রী, চুয়াডাঙ্গা স্টেশন এলাকায় দেখা পান জাহিদ নামের বছর দশেকের এক শিশুর। সে লেখাপড়া করত না। তাকে অ আ ক খ শেখানো শুরু করেন জাহানারা। এরপর একদিন যশোর স্টেশনে দেখা হয় মনিরুল নামের এক ছেলের সঙ্গে। তার পরিবার হতদরিদ্র। কিন্তু সে লেখাপড়া শিখতে চায়। খাতা-কলম কেনার জন্য তাকে এক হাজার টাকা দেন জাহানারা। সেই মনিরুল এখন রংপুর মেডিকেল কলেজের ছাত্র। এখনো মনিরুলের লেখাপড়ার জন্য সাধ্যমতো আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন জাহানারা।

তারপর থেকেই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের খুঁজে তাদের পড়ালেখা করানো শুরু করেন জাহানারা।

জাহানারার বিয়ে হয় ২০১৪ সালে। ওই সময় বাবা জাহানারাকে নগদ তিন লাখ টাকা দিয়েছিলেন। ওই টাকা জাহানারা ব্যাংকে রাখেন। বাবা ও স্বামীর পরিবারের দিক থেকে সোনার গয়না পেয়েছিলেন প্রায় ২০ ভরি। অসহায় শিশুদের পেছনে খরচ করতে করতে ব্যাংকে থাকা তিন লাখ টাকা শেষ হয়ে গেছে। প্রায় ২০ ভরি সোনার গয়নাও বিক্রি করেছেন। তারপরও শিশুদের লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।

তবে এই চলার পথটা শুরুতে একেবারেই মসৃণ ছিল না। তাকে শিশু পাচারকারী ও ছেলে ধরা বদনাম দিয়ে মাথার চুল কেটে দেয় এলাকার কয়েক যুবক। তখন বাড়ি থেকে জাহানারার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করে তার বাবা-মা। তাকে এসব শিশুদের পড়ানো বন্ধ করে দেয়। এভাবে কিছুদিন বন্ধ ছিল তার এই কাজ। তবে হাল ছাড়েননি জাহানারা। সবকিছু ভুলে শুরু করেন পড়ানোর কাজ।

২০১৯ সালে তার স্বপ্ন আবারো ভেঙে দেয় অজানা শত্রুরা। তৎকালীন বেলগাছি সিগন্যাল পাড়ায় তৈরি পথশিশুদের স্কুল ভেঙে দেয় তারা। এরপর শুরু হয় করোনা। করোনাকালীনও থেমে থাকেননি জাহানারা। নিয়মিত অনাথ, এতিম এবং পথশিশুদের খাতা, কলম, ওষুধ, খাবার স্যালাইন দিচ্ছেন। পড়ানোর পাশাপাশি এসব শিশুদের ব্লক, বুটিস ও বাটিকের কাজও শেখাচ্ছেন তিনি।

গত ছয়মাস হলো চুয়াডাঙ্গা পলাশ পাড়ায় একটি ভাড়া বাড়িতে ‘পথশিশু প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়’ করেছেন জাহানারা। টিনশেডের ওই স্কুলটিতে বর্তমানে ৭০ এতিম, অসহায় ও পথশিশু লেখাপড়া করছে। সাতজন শিক্ষক তাদের পড়াচ্ছেন। প্রতি মাসে তাদের ১৯ হাজার ৫০০ টাকা বেতন দেওয়া হয়। অসহায় এসব শিশুদের জাহানারাও পড়ান। এসব শিশুরা তাকে ‘মনি মা’ বলে ডাকে। প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত পড়ালেখা চলে।

ওই স্কুলের শিক্ষার্থী শিশু মিম জানায়, তার বাবা থেকেও নেই। মা নানা বাড়িতে থেকে সেলাইয়ের কাজ করেন। নানাও বেঁচে নেই। তার পড়াশোনা করার খুব ইচ্ছা। কিন্তু উপায় ছিল না। তবে এখন মনি মা’র স্কুলে পড়ছে সে। মনি মা পড়ানোর পাশাপাশি বই, খাতা, কলম সব ফ্রি দেন।

পলাশ পাড়ার রাজমিস্ত্রি জোগালের ছেলে শিশু রিহাদও পড়ে ওই স্কুলে। রিহাদ বলে, ‘আমরা গরিব। বাবা জোগালির কাজ করে। বাবার আয়ে লেখাপড়া করার সামর্থ্য নেই। মনি মা আমাকে লেখাপড়া করার সুযোগ করে দিয়েছে।’জাহানারা বলেন, ‘স্কুলটি দাঁড় করানোই আমার স্বপ্ন। আমাকে অনেক বাধা পেরিয়ে পথ চলতে হচ্ছে। সমাজের বিত্তবানরা কেউ কেউ এগিয়ে আসলে কিংবা সরকারিভাবে সহযোগিতা পেলে স্কুলটি পরিচালনা করা একটু সহজ হতো।’

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সভাপতি সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘জাহানারা অসহায় পথশিশুদের নিয়ে যে কাজ করছে সেটা অনুকরণীয়। পথশিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেশ ও সমাজকে আলোকিত করছেন তিনি। জাহানারা নারী সমাজের অহংকার।’

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম ভুঁইয়া বলেন, ‘জাহানারা এমন একজন নারী যে আসলে বেগম রোকেয়ার মতো পথ চলছে। আসলে পথ সবাই চলে কিন্তু পথ দেখায় কেউ কেউ। জাহানারা আসলে সেই পথ দেখিয়েছে।

‘তিনি আলোক বর্তিকা হাতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। পথশিশুদের খুঁজে বের করে তিনি তাদের মধ্যে শিক্ষার আলো বিনামূল্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তাদের মধ্য থেকে হয়তো একদিন বেরিয়ে আসবে বড় কোনো শিক্ষাবিদ, বড় কোনো শিল্পপতি, বড় কোনো ব্যবসায়ী।’

‘তবে জাহানারা একদিনে এতদূর আসেনি। এজন্য তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জাহানারার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হবে’, বলেন শামীম ভুঁইয়া।

 

মন্তব্য

Beta version