ঝিনাইদহের লাউদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী লামিয়া রহমান। বছরের প্রথম আড়াই মাস পেরোলেও এ খুদে শিক্ষার্থী পায়নি পাঁচটি নতুন পাঠ্য বই। জোগাড় করতে পারেনি পুরাতন বইও। এমন অবস্থায় মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে তার লেখাপড়া।
লামিয়া বলে, ‘আমি স্কুল থেকে বাড়িতে গিয়ে বাংলা ছাড়া অন্য কোনো বই পড়তে পারি না। স্কুলে ম্যাডামরা পড়ালেও বাড়িতে গিয়ে পড়তে না পারায় ইংরেজি, গণিতসহ অন্যান্য বিষয় ভালো মনে থাকে না।’ শুধু লামিয়া নয়- জেলার ৮৬ হাজার ৯৭৩ খুদে শিক্ষার্থী এখনো সব বই পায়নি।
বই না পাওয়ার চিত্র জেলার সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শহরের স্কুলগুলোয় সংকট কিছুটা কম থাকলেও গ্রামের স্কুলগুলোতে সমস্যা প্রকট। স্কুলগুলোর তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীর মধ্যে এখন বই সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পূর্ণাঙ্গ নতুন বই পেয়েছে।
বিভিন্ন স্কুল ঘুরে দেখা যায়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা দুটি করে নতুন বই পেয়েছে। আর পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পেয়েছে মাত্র একটি করে বই। অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী জোগাড় করেছে পুরাতন বই। এমন অবস্থায় শ্রেণিকক্ষে পাঠদান যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি বাড়িতে গিয়েও পড়াশোনা করতে পারছে না খুদে শিক্ষার্থীরা।
জানা যায়, চলতি বছরে জেলায় মোট বইয়ের চাহিদা ছিল ১০ লাখ ৮৫৩১টি। তবে পাওয়া গেছে ৬ লাখ ৫৫ হাজার বই। জেলায় প্রাথমিকে স্কুল রয়েছে ১ হাজার ৪৫৯টি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৪৫ জন।
তৃতীয় শ্রেণিতে মোট শিক্ষার্থী ৪৩ হাজার ৮৪৫ জন। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৬১৫ শিক্ষার্থী দুটি করে নতুন বই পেয়েছে।
আর চতুর্থ শ্রেণির ৪১ হাজার ৯২৩ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৩ হাজার ৯৭২ জন পেয়েছে নতুন দুটি করে বই।
পঞ্চম শ্রেণিতে ৩৫ হাজার ৭৬২ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৫৯৭০ জন শিক্ষার্থী পেয়েছে মাত্র একটি করে নতুন বাংলা বই।
যদিও শিক্ষা কর্মকর্তার দাবি, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা চারটি করেই নতুন বই পেয়েছে। আর পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা তিনটি বিষয়ের নতুন বই পায়নি।
করোতিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী জান্নাতুল বলে, ‘স্কুল থেকে একটি বই দিয়েছে। তাই বাড়িতে অন্য বিষয় পড়তে পারি না। শুধু স্কুলে এসে সহপাঠীদের বই নিয়ে পড়তে হয়। তাও বন্ধুরা অনেক সময় তাদের বই দিতে চায় না।’
একই স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী অনন্যা বিশ্বাস বলে, ‘নতুন ক্লাসে উঠেছি। নতুন বই পড়ব। কিন্তু এখন পুরাতন ছেঁড়া, দাগানো বই পড়তে ভালো লাগে না।’
বই না পাওয়ায় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত অভিভাবকরা।
সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীর অভিভাবক নাদিরা খাতুন বৃষ্টি বলেন, ‘আমার মেয়ে সম্প্রতি দুইটা বই পেয়েছে। তারা বই না পাওয়ায় বাসায় ঠিকমতো পড়াতে পারি না। কারণ তারা লিখবে ও পড়বে। যদি পড়তেই না পাওে, তা হলে লিখবে কি করে।’
তরিকুল ইসলাম নামে আরেক অভিভাবক বলেন, ‘বছরের প্রথম দিনে বই দেওয়ার কথা। কিন্তু আজো পূর্ণ নতুন বই পেল না তারা। তা হলে বছরের প্রথম দিনে বই দেওয়ার কথা বলে ছাত্রছাত্রীদের আশ্বাস দেওয়ার কী দরকার।’
লাউদিয়া এলাকার অভিভাবক নাসিমা খাতুন বলেন, ‘করোনায় শিশুদের লেখাপড়া চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। তার ওপর এখনো তারা বই পেল না। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে তো প্রাথমিকের শিক্ষাব্যবস্থা চরমভাবে ভেঙে পড়বে। সরকারের উচিত অতি দ্রুততার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া।’
ঝিনাইদহ সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লক্ষ্মী রানী পোদ্দার বলেন, ‘আমাদের প্রাথমিকের তিনটি শ্রেণি রয়েছে। এই শিক্ষার্থীরা নতুন বই না পাওয়ায় তাদের লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরাও ঠিকমতো পাঠদান করতে পারছি না। তাদের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। প্রায় প্রতিদিনই তারা বলতেই থাকে বই দিবেন কবে বই দিবেন কবে।’
লাউদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা পর্শিয়া খানম বলেন, ‘বছরের শুরুর দিনে নতুন বই দেওয়ার কথা থাকলেও আমাদের হাতে বই না আসায় শিক্ষার্থীদের বই দিতে পারিনি। কিছু পুরাতন বই ম্যানেজ করে পাঠদান চালাচ্ছি।’
করোতিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জাবের হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীর তুলনায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে যে বই পেয়েছিলাম তা অনেক কম। তাই সবগুলো বই দুটি করে ভাগ ভাগ করে শিক্ষার্থীদের দিয়েছি।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সব শিক্ষার্থীকে বই দেওয়া হয়েছে। দু-একটি বিষয়ে বই দিতে পারিনি। তবে স্কুল খুলে যাওয়ায় তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে কোনো সমস্যা হয়নি।’
জেলা প্রশাসক মনিরা বেগম বলেন, ‘অধিদপ্তরে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছি প্রিন্টিং কার্যক্রমের দায়িত্বরতদের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় প্রাথমিকে বই ছাপানোর কিছু সমস্যা হয়েছে। অতি দ্রুতই বই পেয়ে যাব এবং তা শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।’
মন্তব্য