-->

‘হতাশাগ্রস্ত’ মামুনকে নতুন পথ দেখিয়েছে কেঁচো

সুজন মোহন্ত, কুড়িগ্রাম
‘হতাশাগ্রস্ত’ মামুনকে নতুন পথ দেখিয়েছে কেঁচো
কেঁচো চাষ করে সফলতা পেয়েছেন ২৬ বছর বয়সি মামুন

বেসরকারি ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেন। চাকরির জন্য যান ঢাকাতে। সেখানে কয়েকটি বেসরকারি কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে চাকরিও করেছেন। কিন্তু ২০২০ সালে করোনাকালীন সময়ে পারিবারিক সমস্যার কারণে চাকরি হারান। ফিরে আসেন নিজ জন্মভূমিতে। নিজ বাড়িতে শুরু করেন কেঁচো খামারের ব্যবসা। এখন তিনি সফল উদ্যোক্তা।

বলছি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর রায়গঞ্জ ইউনিয়নের তরুণ উদ্যোক্তা মামুনুর রশীদ মামুনের কথা। কেঁচো চাষ করে সফলতা পেয়েছেন ২৬ বছর বয়সি এই যুবক।

খুব অল্প পুঁজি কাজে লাগিয়ে সফল হয়েছেন মামুন। নিজের সফলতার জন্য ২০২১ সালের কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আয়োজিত মুজিব শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ‘শত কৃষকের সম্মাননা’ স্মারকও পেয়েছেন। বর্তমানে তার খামারে কেঁচো সারের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৭২ টন।

সম্প্রতি মামুনের কেঁচো খামারে ঘুরে আসেন দৈনিক ভোরের আকাশের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি। সেখানে গিয়ে এই প্রতিনিধি দেখতে পান, মামুন তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খামারে কাজ করছেন। এ সময় কথা হলে নিজের গল্প তুলে ধরেন তিনি।

মামুন জানান, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। করোনার সময় চাকরি হারান। মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। পরে নিজের হতাশা কাটিয়ে নিজ মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে একটি পরিত্যক্ত ঘরে কেঁচোর খামার শুরু করেন। শুরুতেই তিনি মাত্র চার হাজার টাকা ব্যয় করে ছয়টি রিং এবং রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে দেড় কেজি কেঁচো নিয়ে আসেন। এরপর নিজ বাড়ির পরিত্যক্ত জায়গায় শুরু করেন কেঁচোর উৎপাদন।

একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের প্রতিষ্ঠান ‘ক্রিয়েশনস বিজনেস’ নাম দিয়ে অনলাইন মার্কেটিংয়ে প্রচার শুরু করেন। অল্প সময়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। কয়েক মাসের মধ্যে খামারে নতুন করে ২৪টি রিং বসান তিনি।

এরপর আরো ১০ শতক জায়গায় নতুন করে ৫৬টি রিং বসিয়ে শেড তৈরি করেন। বাকি জায়গায় স্তূপ প্রক্রিয়ায় উৎপাদন করেন কেঁচো কম্পোস্ট। বর্তমানে তার দুটি খামার থেকে প্রতিমাসে প্রায় ৬ টন জৈবসার উৎপাদন হয়।

উৎপাদনশীলতার দিক থেকে মামুনের খামারটি এখন জেলার সবচেয়ে বড় কেঁচো খামার। তিনি তার খামারে ভার্মি-কম্পোস্ট তৈরি করতে গ্যাসমুক্ত বাসি গোবর, কলাগাছের কুচি ও কেঁচো ব্যবহার করেন।

মামুন বলেন, ‘আমাদের জেলায় কৃষিজমির জন্য অত্যন্ত উপকারী হওয়ায় এই সারের চাহিদা প্রচুর। সার উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বিক্রি হয়। স্টক করে রাখার প্রয়োজন হয় না। প্রতি কেজি সার খুচরা ২০-২৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। পাইকারি দরে ১০-১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় এই কেঁচো সার। সার বিক্রি করে প্রতিমাসে আমার প্রায় ২৫-৩০ হাজার টাকা মুনাফা আসে। এ ছাড়া কেঁচোও বিক্রি হয়। হতাশা কাটিয়ে আল্লাহর রহমতে আমি এখন আগের থেকে ভালো অবস্থানে আছি।’

ছেলের সাফল্য নিয়ে কথা হয় মামুনের মা মর্জিনা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এক সময় খুব অসহায় জীবনযাপন করেছি। তারপর ছেলে কেঁচোর খামার শুরু করে। এখন আমরা স্বাবলম্বী হতে পেরেছি। এই খামারের আয় দিয়েই আমাদের সংসার চলে।’

ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে মামুনের বড় বোন শারমিন আক্তার নিজেও হয়েছেন একজন সফল উদ্যোক্তা। অন্যের জমি লিজ নিয়ে গাছের চারা উৎপাদন করছেন তিনি। মামুনের খামার থেকে ভার্মি কিনে চারা উৎপাদন করছেন।

তিনি বলেন, ‘মামুনের কাছ থেকে শিখে আমি নিজে নার্সারি তৈরি করেছি। এখন ওর কাছ থেকে কেঁচো সার কিনে নার্সারিতে ব্যবহার করছি। বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম হার দারুণ। এ সার ব্যবহার করে সুস্থ-সবল চারা উৎপাদন করছি। গ্রাহকের চাহিদাও বেড়েছে।’

স্থানীয় কৃষক লাল মিয়া বলেন, ‘মামুন শুরুতে ঘরের ভেতর গোবর দিয়ে কি করছে আমরা বুঝি নাই। পরে দেখি ধীরে ধীরে বড় হলো খামার। এখন এই সার আমি নিজেই কিনি। বাইরে থেকে গাড়ি এসে তার কাছ থেকে কিনেও নিয়ে যায়। দোকানদাররাও কেনে।’

স্থানীয় বাজারের সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী রাশিদুল ইসলাম বলেন, ‘মামুনের খামার থেকে ভার্মি-কম্পোস্ট কিনে বিক্রি করি। এই সার সব ধরনের ফসলে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই সারের চাহিদা প্রচুর।’

মামুনের সফলতা দেখে কেঁচো খামারে উদ্যোগী হয়েছেন তার এলাকার অনেক যুবক। তেমনই একজন ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামের আপেল মাহমুদ। কথা হয় আপেলের চাচা আনোয়ার হকের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘মামুনের পরামর্শে আমার ভাতিজাও কেঁচো খামার শুরু করেছে। প্রথমে দুটি রিং দিয়ে শুরু করলেও এখন তার পাঁচটি রিঙে কেঁচো এবং সার উৎপাদন হচ্ছে।’

নাগেশ্বরী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. মনজুর আলম বলেন, ‘আমি তার খামারে গিয়েছিলাম। সে কেঁচো সার উৎপাদন করছে। কেঁচো সার উৎপাদনে তার সফলতা আশপাশের যুবকদেরও উদ্যমী করছে। এটি আমাদের জেলার জন্য খুব ভালো উদ্যোগ।’

উপজেলা কৃষি অফিসার মো. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘এ সারটি আসলে মাটির প্রাণ। বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে এর বিকল্প নেই। আমি কৃষি বিভাগ থেকে সর্বদা তার পাশে আছি। পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।’

মন্তব্য

Beta version