-->
শিরোনাম
অস্তিত্ব সংকটে গারো পাহাড়

দখলদারদের হাতে দুই হাজার একর জমি

শাকিল মুরাদ, শেরপুর
দখলদারদের হাতে দুই হাজার একর জমি
শেরপুরের শ্রীবরদীর বালিজুড়ি এলাকায় বনের জমিতে গচ্ছে চাষাবাদ, বন কেটে তৈরি করা হয়েছে বাড়ি। ছবি: শাকিল মুরাদ/ ভোরের আকাশ।

শেরপুরের নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্ত জুড়ে গারো পাহাড় অবস্থিত। এই বিশাল বনভূমি প্রায় পুরোটাই বন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। এই তিন উপজেলার তিন রেঞ্জের আওতায় প্রায় ২০ হাজার একর বনভূমি রয়েছে। তবে এর মধ্যে বনভূমির দুই হাজার একর জমি এখন দখলদারদের হাতে। যার বর্তমান বাজার মূল্য ১১৬ কোটি টাকার বেশি।

মূলত গারো পাহাড় কেটে প্রতিনিয়ত চাষাবাদের জমি, নতুন নতুন বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। আবার দীর্ঘদিন ধরে বসবাসের দোহাই দিয়ে জমি ছাড়ছেন না দখলদাররা। এতে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে গারো পাহাড়।

বন বিভাগের তথ্যমতে, শেরপুর বন বিভাগের আওতায় রাংটিয়া রেঞ্জে আট হাজার ৮৮০ একর, মধুটিলা রেঞ্জে চার হাজার ২৩৫ একর এবং বালিজুড়ি রেঞ্জে সাত হাজার ৩০০ একর বনভূমি রয়েছে। এই তিন রেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাংটিয়া রেঞ্জে এক হাজার ২০০ একর বনভূমি বেদখলে রয়েছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য ৭৫ কোটি ১৩ লাখ ৬০ হাজার ৬২৭ টাকা।

অন্যদিকে বালিজুড়ি রেঞ্জের আওতায় ৪৭০ একর বনভূমি বেদখলে রয়েছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য ২০ কোটি ৫০ লাখ ৬২ হাজার ২৪৯ টাকা। মধুটিলা রেঞ্জের আওতায় ৬০২ একর বনভূমি বেদখলে রয়েছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য ২২ কোটি এক লাখ ৫৩ হাজার ৬৫৫ টাকা।

শেরপুরের শ্রীবরদীর বালিজুড়ি সীমান্তে বনের জমির গাছ কেটে আগুন দিয়ে আগাছা পুড়িয়ে চাষাবাদের উপযুক্ত করে তুলছেন কৃষকরা। শাকিল মুরাদ/ ভোরের আকাশ।

 

তবে গেল চার থেকে পাঁচ মাসে বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের অভিযানে বালিজুড়ি রেঞ্জে ৪০ একর, রাংটিয়া রেঞ্জে ৭০ একর ও মধুটিলা রেঞ্জ থেকে ২৫ একর জমি দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো দুই হাজার একরের উপরে জমি দখলদারদের হাতে রয়েছে।

এদিকে বনভূমি দেখভাল ও রক্ষায় যে পরিমাণ জনবল থাকা প্রয়োজন, সেই পরিমাণে জনবল নেই বলে দাবি বন বিভাগের। ফলে নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান ব্যাহত হচ্ছে।

নালিতাবাড়ীর পানিহাটা গ্রামের বাসিন্দা ফকির মিয়া বলেন, ‘আমার কোনো জায়গা জমি নেই, আমি বনের একটু জমির মধ্যে কোনোমতে থাকি। যদি বন ছাড়তে বলেন, ছাইড়ি দিমু। কিন্তু বন দখলদারদের সঙ্গে আমার নাম জড়াবেন না।’

ঝিনাইগাতীর রাংটিয়া এলাকায় বনের জমিতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছেন জিতার আলী (১১৭)। তিনি বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের আগে থাইক্কা এইহানে আমরা থাহি। বন থনে (থেকে) হরাই (সরিয়ে) দিলে আমরা কই যামু। আমগর আরেক জায়গায় থাহার ব্যবস্থা হইলে, তাইলে আমরা যামু গা।’

শেরপুরের শ্রীবরদীর বালিজুড়ি সীমান্তে বনের জমির গাছ কেটে চাষাবাদের উপযুক্ত করে তুলছেন কৃষকরা। শাকিল মুরাদ/ ভোরের আকাশ।

 

গজনী এলাকার কৃষক হেকমত আলী বলেন, ‘আমি বাপের কাছ থেকে এই জায়গা পাইছি। আমি এহন বউ-পুলাপান লইয়া এই জাগাতি থাহি। এই গ্রামেই চাষাবাদ কইরা খাই। আমগোরে এইহান থেকে তুইলা দিলে কই যামু? তয় আমগোরে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা কইরা দিলে এহান থিয়া চইলা যামু।’

প্রকৃতি ও পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মেরাজ উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিনিয়ত বনের জমি দখল হচ্ছে। এতে বন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এক সময় এই বনে সবুজের সমারোহ ছিল, এখন অনেকটাই কমে গেছে।

‘এটা শুধু দখলদারদের কারণে হয়েছে। তাই আমরা প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করি, যাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে দখলদারদের কবল থেকে বন রক্ষা করে। আর বন বিভাগের প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে, তারা যেন জমি উদ্ধারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে।’

শেরপুরের ঝিনাইগাতীর রাংটিয়া এলাকায় বনের জমি কেটে যাতায়াতের জন্য তৈরি করা হয়েছে রাস্তা। শাকিল মুরাদ/ ভোরের আকাশ।

ঝিনাইগাতী উপজেলা চেয়ারম্যান এসএমএ ওয়ারেজ নাঈম বলেন, ‘সীমান্তের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এখানে বসবাস করছেন। হুট করে তাদের সরানো যাবে না। পর্যায়ক্রমে তাদের পুনর্বাসন করে সরাতে হবে।’

শেরপুরের সহকারী বন সংরক্ষক আবু ইউসুফ বলেন, ‘যারা বনের ভেতরে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা, খামার করছেন তাদেরকে উচ্ছেদে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ‘এরই মধ্যে তিন রেঞ্জের অনেক জমি উদ্ধার করেছি। তবে যারা বনের ভেতরে দীর্ঘ সময় ধরে বসবাস করে আসছেন, তাদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে বন থেকে উচ্ছেদ করা হবে। আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যে বনের জায়গা বাড়তে থাকবে।

‘আমরা দখলদারদের তালিকা তৈরি করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়েছি। উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জবরদখলকারী যে-ই হোক না কেন, আমরা বন বিভাগের জমি অবশ্যই অবৈধ দখলমুক্ত করার চেষ্টা করব’, বলেন আবু ইউসুফ।

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোমিনুর রশীদ বলেন, ‘জমি দখলকারীদের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্সে রয়েছি। এরই মধ্যে জেলার কয়েকটি জায়গায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে।’

মন্তব্য

Beta version