ক্রমেই জলাশয়শূন্য হয়ে পড়ছে যশোর। আইন অমান্য করে বছরের পর বছর শহর, শহরতলি, এমনকি গ্রামেও একের পর এক ভরাট করা হচ্ছে জলাধার। দুই দশকে যশোর শহর ও শহরতলির চাঁচড়া মৌজায় ২০টি, বারান্দী মৌজায় সাতটি, খড়কী মৌজায় ২৬টি, পালবাড়ী মৌজায় ১৬টি পুকুর ভরাট করা হয়েছে।
ভরাটকারীরা সরকারি আইন বা সামাজিক বাধাকে আমলে নিচ্ছেন না। কেউ কেউ পুকুর ভরাটে প্রভাবশালী বা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ব্যবহার করছেন।
জলাধার হারিয়ে যাওয়ায় কমেছে অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ সুবিধা। বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে পানির জন্য আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসকে বেগ পেতে হচ্ছে। একই সঙ্গে জলাশয় ভরাটের ফলে ইকোসিস্টেম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশের ওপর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
এ ছাড়া জলাশয়কে পানি সংরক্ষণাগার বলা হয়। জলাশয়ের পানি শোধন হয়ে ভূস্তরে গিয়ে মেশে। এতে পানির স্তর স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু জলাশয় ভরাট হওয়ায় পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে যশোর শহরের টিউবওয়েলে পানি ওঠে না। এ সময় খাবার পানির জন্য চলে হাহাকার।
প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী কোনো পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী, প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার, ভাড়া, ইজারা বা হস্তান্তর বেআইনি। ১৯৫১ সালের পরিবেশ আইন অনুযায়ী কোনো মৎস্য উৎপাদনকারী পুকুর-দীঘি পরিবেশ ও মৎস্য অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া ভরাট করা যাবে না।
যশোর পৌরসভার হিসেবে সরকারি-বেসরকারি শতাধিক জলাশয় রয়েছে। তবে তা খাতা-কলমে সীমাবদ্ধ। কেননা প্রতি বছর দু-তিনটি করে জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দুই বছর আগেও সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে পৌর এলাকার ৯টি ওয়ার্ডে ছোট-বড় ৩৫টি পুকুর ছিল। এখন সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে ২০টির মতো।
স্থানীয়রা জানান, ওই আইন অমান্য করে শহরের রেলগেটস্থ চোরমারা দীঘি রাতের আঁধারে ভরাট হয়ে গেছে। ২৬ বিঘা আয়তনের ভরাটকৃত দীঘিটি প্লট করে বিক্রি হয়েছে। এখন চলছে ভবন নির্মাণের কাজ।
২০১৯ সালে শহরের বেজপাড়ায় একটি বড় পুকুর ভরাট করে সীমানাপ্রাচীর দিয়েছে আইটি পার্ক কর্তৃপক্ষ। যশোর পৌরসভার অন্যতম বড় জলাশয় আরবপুর দীঘি। এ দীঘি ভরাট করা হয়েছে কয়েক বছর আগে। এখন সেই দীঘি পুরো খেলার মাঠ। এ ছাড়া শহরের সবচেয়ে বড় বিপণিবিতান জেস টাওয়ার ও সিটি প্লাজাও গড়ে উঠেছে পুকুর ভরাট করে। সার্কিট হাউসপাড়ায় পুকুর ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে বাড়ি। এভাবে শহরের অধিকাংশ পুকুর-দীঘি ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রে আরো জানা গেছে, শহরের মুজিব সড়ক এলাকার অধিকাংশ অভিজাত বস্ত্র বিপণি গড়ে উঠেছে জলাশয় ভরাট করে। বেজপাড়ার এমএসটিপির দক্ষিণ গেটের সামনের পুকুর, পোস্ট অফিসের সামনের পুকুর, চিড়া মাগুরপট্টি ও আখপট্টির পুকুর ভরাট করে তৈরি হয়েছে বড় বড় ইমারত।
এ দিকে শহরের মিশনপাড়া, কাজীপাড়া, বেজপাড়া, ষষ্ঠীতলাসহ প্রায় প্রতিটি এলাকার পুকুরগুলো ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে সুউচ্চ অট্টালিকা। বিমানবন্দর সড়কের বাঁচতে শেখার বিপরীতে একটি বড় পুকুর ভরাট করে নির্মাণ হয়েছে বহুতল ভবন।
এ ব্যাপারে এমএম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সোলজার রহমান বলেন, ‘শহরাঞ্চলে যখন একটি পুকুর হয়, সেটি জনগণের সম্পদে পরিণত হয়, ইচ্ছা করলেই ওই জমির মালিক পুকুরটি বন্ধ করে ইমারত তৈরি করতে পারে না।’
‘একটি জলাশয় মাইক্রো ক্লাইমেট রক্ষা করে, বায়ু চলাচল স্বাভাবিক রাখে, পুকুর সংশোধক প্রক্রিয়ায় পানিতে বসবাসরত অণুজীব ও ব্যাকটেরিয়াকে খাদ্যের আধারে রূপ দেয়, যেটা প্রাণিজ সম্পদ রক্ষা করে।
‘ভূ-উপরিভাগের জলাশয় না থাকলে পানির লেয়ার কমে যাবে। যার কারণে গভীর থেকে পানি উত্তোলন করতে হবে, এ গভীর স্তরে আছে প্রচুর পরিমাণে সালফার এবং আর্সেনিক, যা মানব শরীরে প্রচণ্ড ক্ষতি করে’, বলেন তিনি।
সোলজার রহমান বলেন, একটি পুকুর তার আশপাশের উদ্ভিদ জন্মাতে সাহায্য করে, পুকুর না থাকলে মরুকরণ হবে; যার কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয় হবে।
যশোর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আজিজুল হক বলেন, অগ্নিনির্বাপণের জন্য জলাশয়ের পানি উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জলাশয় ভরাট হয়ে গেলে পানি সংকটে পড়তে হয়। জলাশয় সংকটের বিষয়টি মেয়র ও ডিসি মহোদয়কে জানিয়েছি। এ ছাড়া বড় বড় ভবনে রিজার্ভ পানির ব্যবস্থা করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু জানামতে, অধিকাংশ ভবনে নিজস্ব পানি রিজার্ভের ব্যবস্থা নেই।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর যশোরের উপ-পরিচালক সাঈদ আনোয়ার জানান, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন উপেক্ষা করে যদি পুকুর ভরাট করা হয়, তা হলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।ব্যক্তিমালিকানাধীন হিসেবে রেকর্ড করা পুকুরগুলো জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০-এর ২ (চ) ধারায় প্রাকৃতিক জলাধারের সংজ্ঞাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সে অনুযায়ী ব্যক্তিমালিকানার পুকুর চাইলেই ভরাট করা যাবে না।
যশোর পৌরসভার শহর পরিকল্পনাবিদ সুলতানা সাজিয়া বলেন, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানির উৎস কমে যাচ্ছে। আমরা এরই মধ্যে জলাশয় শ্রেণির জমিতে ভবন নির্মাণের প্লান পাস করছি না।
তিনি বলেন, ছয় তলার ওপরের ভবন নির্মাণ করতে হলে পাশে জলাশয় থাকা জরুরি। এ জন্য সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে।
মন্তব্য